আলেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল এর ১৭২তম জন্মদিন আজ
আজ ৩ মার্চ, আলেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল এর ১৭২ তম জন্মবার্ষিকী। ১৮৪৭ সালের এই দিনে যুক্তরাজ্যের এডিনবার্গের এক স্কটিশ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন চিরভাস্বর এই উদ্ভাবক, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, অধ্যাপক এবং বধির শিক্ষকসহ অসংখ্য গুণে গুণান্বিত ব্যক্তিত্ব।
গ্রাহাম বেল বিশ্বে সবচেয়ে পরিচিত টেলিফোনের আবিষ্কারক হিসেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান অ্যামেরিকান টেলিফোন অ্যান্ড টেলিগ্রাফ কোম্পানি(এটিঅ্যান্ডটি)’রও প্রতিষ্ঠাতা তিনিই।
টেলিফোন আবিষ্কার
টেলিফোন আবিষ্কারের পেছনে একটি বিরাট মহত্বের পটভূমি রয়েছে বেল এর। গ্রাহাম বেল এর বাবা, দাদা এবং ভাই শব্দতত্ত্ব ও প্রমিত উচ্চারণ নিয়ে কাজ করতেন। বেলও তাদের এই কাজে প্রভাবিত হয়ে নতুনভাবে কিছু একটা করার চেষ্টা করলেন। দুর্ভাগ্যবশত তার মা এবং স্ত্রী উভয়ই বধির ছিলেন। তাদের শ্রুতির উন্নয়নের জন্য কাজ করতে গিয়ে টানা দুই বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ১৮৭৬ সালে টেলিফোন আবিষ্কার করে ফেলেন। সে বছরই মার্কিন সরকারের পেটেন্ট লাভ করেন। বেল তার আবিষ্কৃত টেলিফোনকে বৈজ্ঞানিক কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেন। পরবর্তী জীবনে আরও বহু প্রয়োজনীয় আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের কাজে জড়িয়ে পড়েন।
শৈশব
স্কটল্যান্ডের এডিবার্গের সাউথ শার্লট স্ট্রিটে শৈশব কাটে আলেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল এর। তিন ভাইয়ের পরিবারে বেল ছিলেন মেজো। বড় ভাই মেলভিলে জেমস বেল এবং ছোটভাই এডওয়ার্ড চার্লস বেল এর মধ্যে বয়সের ব্যবধান ছিল মাত্র এক বছর করে। সুতরাং সমবয়সী বন্ধুর মতই কেটেছে তিন ভাইয়ের শৈশব। বাবা আলেক্সান্ডার মেলভিলে বেল ছিলেন একজন ধ্বনি বিজ্ঞানী।
প্রথম উদ্ভাবন
ছোটবেলা থেকেই আবিষ্কার আর উদ্ভাবনের নেশায় মত্ত ছিলেন গ্রাহাম বেল। মাত্র ১২ বছর বয়সে তৈরি করেন প্যাডেল চালিত পেষণ যন্ত্র। প্রতিবেশি বন্ধু বেন হার্ডম্যান এর পরিবারের ছিল আটার মিল। চাল-গম পিষে আটা বের করার সেকেলে পদ্ধতি ছিল বেশ শ্রমসাধ্য। বেল সেসময় প্যাডেল চালিত সরল একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন যা তুলনামূলক কম পরিশ্রমে অধিক আটা তৈরি করতে পারত। বন্ধুর বাবা জন হার্ডম্যান কিশোর বেল এর এই আবিষ্কারে অভিভূত হয়ে পড়েন এবং তাকে একটি ছোট্ট ‘গবেষণাগার’ বানিয়ে দেন।
সংস্কৃতিমন্য
শৈশব থেকেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেশ ভাল দখল ছিলে বেল এর। চিত্রাঙ্কন, কবিতা এবং গানের প্রতি ছিল তার স্বভাবসুলভ ঝোঁক। মায়ের উৎসাহে সংস্কৃতির আঙিনায় ঘুরে বেড়ানো বেল কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই পিয়ানোয় ভাল সুর তুলতে পারতেন এবং পরবর্তীতে পারিবারিক পিয়ানো বাদকে পরিণত হন।
শিক্ষাজীবন
গ্রাহাম বেল এর শিক্ষাজীবন শুরু হয় নিজের ঘরেই। শিক্ষক পিতার সাহচর্যে বাস্তব জ্ঞান নিয়ে বেড়ে ওঠা বেল এর প্রথম বিদ্যালয়জয়বন শুরু হয় এডিনবার্গের রয়্যাল হাই স্কুলে। ১৫ বছর বয়সে মাত্র চার ক্লাশে উন্নীত বেল বাজে ফলাফলের জন্য বহিষ্কৃত হন। এরপর দাদার সাথে ইংল্যান্ড সফরে গিয়ে শিক্ষা সম্পর্কে কিছুটা আগ্রহী হন। সহোদরদের সাথে তার বাচিক ও ভাষিক উন্নয়নের জন্য গৃহশিক্ষক রাখা হয়। এতে কাজ হয়। শব্দতত্ত্ব ও সঙ্গীত নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনার জন্য এলগিনের ওয়েস্টন হাউজ একাডেমিতে ভর্তি হন। পরবর্তীতে সেই প্রতিষ্ঠানেই ল্যাটিন ও গ্রীক ভাষার শিক্ষক নিযুক্ত হন মাত্র ১০ পাউন্ড পারিশ্রমিকে। ১৮৬৮ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে ভর্তির সুযোগ পান। পরবর্তীতে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার সুযোগ পান বেল।
শ্রুতি নিয়ে কাজ
১৮৭১ সালে আমেরিকার বস্টন, ম্যাসাচুসেটস ও যুক্তারাষ্ট্রে মূক ও বধির প্রতিষ্ঠানে বক্তৃতা দেবার জন্য বস্টন স্কুল ফর ডেফ-মিউট এর প্রিন্সিপাল সারাহ ফুলারের আমন্ত্রণ পান বেলের বাবা। কিন্তু ঘটনাক্রমে বেলের বাবা তাকেই পাঠিয়ে দেন নিজের পরিবর্তে। বেল এর বক্তৃতা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং আয়োজকদের অনুরোধে একই বক্তৃতা হার্ডফোর্ড, কানেক্টিকাট, নর্দাম্পটন ও ম্যাসাচুসেটসে উপস্থাপন করেন।
এর ছয় মাস পর ‘হারমোনিক টেলিগ্রাফ’ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন বেল। তার গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল একটি তারের মধ্যে দিয়ে বার্তা আদানপ্রদান উপযোগী যন্ত্র নির্মাণ যা একই সাথে ট্রান্সমিটার ও রিসিভার হিসেবে কাজ করবে।
লন্ডনে শিক্ষার পাঠ অসমাপ্ত রেখেই বোস্টনে শিক্ষক হিসেব কাজ শুর করেন বেল। তার বাবার পরিচয় সূত্রে সেখানকার নামী আইনবিদ গার্ডিনার গ্রিনি হার্বার্ডের সহায়তায় বধির স্কুলের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন বেল। ১৮৭২ সালের অক্টোবরে বেল ‘স্কুল অব ভোকাল ফিজিওলজি অ্যান্ড মেকানিক্স অব স্পিচ’ নামে মূক ও বধির ব্যক্তিদের জন্য প্রতিষ্ঠান চালু করেন এবং শুরুতেই ব্যাপক সাড়া পান। তার প্রথম শ্রেণীতেই ৩০ জন বধির শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। এর পাশাপাশি প্রাইভেট টিউটর হিসেবেও কাজ করতেন বেল। তার শিক্ষার্থীদের মধ্যে অন্যতম হলেন বিখ্যাত মার্কিন ঔপন্যাসিক হেলেন কেলার, যিনি একই সাথে মূক-বধির ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছিলেন। বেল তার কর্মে নিজেকে প্রায় উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন এবং প্রচুর পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে তার শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করতেন।
পরবর্তী আবিষ্কার সমূহ
ফটোফোন: বেল তার সহকারী চার্লস সামনার টাইন্টারের সাথে যৌথভাবে তারবিহীন টেলিফোন আবিষ্কার করেন যার নাম দেন ফটোফোন। এটি শব্দ এবং মানুষের কথোপকথন আলোকরশ্মির সাহায্যে প্রেরিত হত। পরবর্তীতে তারা দুজনই ভোল্টা ল্যাবের পূর্ণসহযোগী হিসেবে যোগদান করেন।
মেটাল ডিটেক্টর: মেটাল ডিটেক্টরের আদি উদ্ভাবক হিসেবে গ্রাহাম বেল এর নাম চিরস্মরণীয়। ১৮৮১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেমস গারফিল্ডের শরীর থেকে বুলেট খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে বেল উদ্ভাবিত এই যন্ত্র সারা বিশ্বের আলোড়ন সৃষ্টি করে।
হাইড্রোফয়েলস: ১৯০৬ সালে সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকার এক আর্টিকেলে উইলিয়াম ই. হাইড্রোফয়েল এবং হাইডোপ্লেন মডেল এর বর্ণনা দেন। পরবর্তীতে বেল ও তার সহযোগী ফ্রেডরিক ডব্লিউ ক্যাসি বালডউইন মিলে ১৯০৮ সালে উড়ন্ত জলযান হিসেবে পানির উপর থেকে একটি হালকা বিমান উড্ডয়নের পরীক্ষায় সফল হন।
অ্যারোনটিকস: বিমানবিদ্যায়ও পারদর্শী ছিলেন গ্রাহাম বেল। ১৮৯৮ সালে টেট্রাহেড্রাল বক্স কাইড মডেলের উড়োযান উড্ডয়ন করেন বেল। মেরুন সিল্কের ডানার এই উড়োযানের নাম দিয়েছিলেন সিগনেট-১,২ ও ৩।
ইউজিন: কেবল যন্ত্রবিদ্যায়ই নয়,মলিকুলার বায়োলজিতেও অগাধ জ্ঞান ছিল বেলের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউজিন আন্দোলনে তিনিও ছিলেন একজন সক্রিয় কর্মী। ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অভ সায়েন্সেস এ ১৩ নভেম্বর ১৮৮৩ তারিখে বধির ব্যক্তির জিনোমের উন্নয়নের মাধ্যমে সুস্থ স্বাভাবিক ভ্রূণ উৎপাদন শীর্ষক জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা প্রদান করেন বেল।
সম্মাননা
আজীবন মানব উৎকর্ষে নিয়োজিত এই ব্যক্তিকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রি ও সম্মাননা প্রদান করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কানাডাসহ বেশ কয়েকটি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আটটি সম্মানসূচক এলএলডি(ডক্টর অভ লজ), দুটি পিএইচডি, একটি ডিএসসি এবং একটি এমডি ডিগ্রী প্রদান করা হয়।
১৯৪০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডাক বিভাগ তার নামে ডাকটিকেট প্রকাশ করে। এছাড়া বিশ্বব্যাপী নামী সব প্রতিষ্ঠানের অসংখ্য পুরষ্কার ও সম্মাননা তিনি গ্রহণ করেন।
জীবনাবসান
১৯২২ সালের ২ আগস্ট ডায়াবেটিস জনিত জটিলতা ৭৫ বছর বয়সে কেপ ব্রিটনের নিজ বাসভবনে জীবনাবসান ঘটে আধুনিক বিশ্বের অন্যতম একজন রূপকারের।
মহান এই উদ্ভাবক ও বিজ্ঞানীর ১৭২ তম জন্মবার্ষিকীতে রায়ান্স নিউজ গভীর শ্রদ্ধার সাথে তাঁকে স্মরণ করছে।
কোন মন্তব্য নেই