সাম্রাজ্য টেকাতে নেটফ্লিক্সের নতুন কৌশল
গত বছর করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে অবস্থাপন্নদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের তালিকায় নতুন একটি খাত যুক্ত হয়েছে। চিত্ত বিনোদনের সেই খাত পুরোপুরি ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলোর দখলে। আর কে না জানে, ভিডিও স্ট্রিমিংয়ে নেটফ্লিক্সের প্রবল প্রতাপের কথা। যদিও চলতি বছর নেটফ্লিক্সের রোজগারের উজানে ভাটার সংকেত। ঠিক সেই সময়েই নতুন কৌশল নিয়ে হাজির হচ্ছে নেটফ্লিক্স।
মহামারির শুরু থেকেই ভিডিও স্ট্রিমিং ব্যবসার পালে লাগে জোর হাওয়া। বাড়তে থাকে নেটফ্লিক্সের গ্রাহকের সংখ্যা। নতুন গ্রাহকদের উপচে পড়া ভিড়ে ২০২০ সালের প্রথমার্ধে নেটফ্লিক্সের শেয়ারের দাম বেড়ে যায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। সুযোগ বুঝে নিজেদের কনটেন্টের সংগ্রহ বড় করার দিকেও মনোযোগ দেয় প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু করোনার টিকা আবিষ্কার ও এর প্রয়োগহেতু কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের সংস্কৃতি থেকে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের দেশগুলো বের হতে শুরু করায় গ্যাঁড়াকলে পড়ছে নেটফ্লিক্স। মানুষের বাধ্য হয়ে ঘরে থাকার সময়টায় সময় কাটানোর অন্যতম সঙ্গী ছিল নেটফ্লিক্স। কিন্তু চলতি বছরের শুরু থেকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চল শুরু হওয়ায় নেটফ্লিক্স থেকে গ্রাহকদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার হার বাড়ছে। শুধু আমেরিকা ও কানাডার বাজারেই এ বছর চার লাখের বেশি গ্রাহক হারিয়েছে নেটফ্লিক্স। একই অবস্থা এশিয়ার বাজারেও। এর ছোঁয়া লেগেছে শেয়ারবাজারেও। জুলাইয়ের ২১ তারিখ পর্যন্ত দেখা হিসাবে নেটফ্লিক্সের শেয়ারের দাম কমেছে প্রায় ৩ শতাংশ।
ডিভিডি ভাড়া দিয়ে ব্যবসা শুরু করা নেটফ্লিক্স এখন বিশ্বের বিনোদন জগতের অন্যতম বড় ব্র্যান্ড। ভিডিও স্ট্রিমিং যে লাভজনক ব্যবসায়িক মডেল হতে পারে, তা বলতে গেলে একাই প্রতিষ্ঠিত করেছে এই প্রতিষ্ঠান। রোজগারে ভাটার ইঙ্গিত পেয়ে এবার স্ট্রিমিং ব্যবসার মধ্যেই নতুন মাত্রা নিয়ে আসছে তারা। সম্প্রতি নেটফ্লিক্স ঘোষণা দিয়েছে, গ্রাহকদের জন্য আগামী বছরের মধ্যে ভিডিও গেমস নিয়ে আসবে তারা। আর সেই গেমস খেলার জন্য আপাতত বাড়তি কোনো খরচ করতে হবে না গ্রাহকদের। এর মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক গেমিং ব্যবসাতেও পা রাখতে চলেছে নেটফ্লিক্স।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রিড হেস্টিংস এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, গেমিং নিয়ে এলেও নেটফ্লিক্সের মূল মনোযোগ থাকবে বিনোদন কনটেন্টেই। বিশ্লেষকেরা বলছেন, গেমিং দিয়ে আসলে বিশ্বজুড়ে গ্রাহকদের মধ্যে বাড়তি আকর্ষণ সৃষ্টি করতে চাইছে নেটফ্লিক্স। এবং এই গেমসের মধ্য দিয়ে আবার দর্শকদের ভিডিও কনটেন্টে আকর্ষণ করার চেষ্টা থাকবে। সিনেমা ও অরিজিনাল সিরিজের পাশাপাশি যে কারণে প্রামাণ্যচিত্র ও অন্যান্য কনটেন্টের সমাহার গড়ে তুলছে নেটফ্লিক্স, সেই একই কারণে এবার নিয়ে আসা হচ্ছে গেমিং। অর্থাৎ কনটেন্টের একটি বিশাল চক্র তৈরি করতে চাইছে প্রতিষ্ঠানটি, যেখানে এক বিভাগ অন্য বিভাগের জন্য অনুগত গ্রাহক তৈরিতে ভূমিকা রাখবে।
যদিও নেটফ্লিক্সের বর্তমান সংকট এখনো প্রবল হয়নি। পরিসংখ্যান প্রতিষ্ঠান অ্যান্টেনা বলছে, এখনো এক মাস ব্যবহারের পর অন্যান্য ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম যে হারে গ্রাহক হারায়, নেটফ্লিক্সের ক্ষেত্রে ততটা নয়। আবার বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান মফেট নাথানসন বলছে, অন্যান্য ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের তুলনায় গ্রাহকদের কাছ থেকে বেশি আয়ও করে নেটফ্লিক্স। অন্যদিকে আমেরিকা ও কানাডার বাইরে থেকে আয়ের হারেও এগিয়ে প্রতিষ্ঠানটি। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও অন্যান্য প্রতিযোগীর তুলনায় এগিয়ে আছে তারা। তারপরও সিঁদুরে মেঘ দেখেই ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে নেটফ্লিক্স।
এর মূল কারণ, এখন বাজারে আছে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। একদিকে আছে ডিজনি, আমাজন ও অ্যাপলের মতো জায়ান্টরা। অন্যদিকে বাজারে চালু হয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বীদের জোট বাঁধার চল। ডিসকভারির সঙ্গে মিশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত এরই মধ্যে নিয়ে ফেলেছে ওয়ার্নার মিডিয়া। তার মধ্যেই আবার শোনা যাচ্ছে, এনবিসি ইউনিভার্সালের মালিক প্রতিষ্ঠান কমকাস্ট ও মিডিয়া গোষ্ঠী ভায়াকম্বসের মিলে যাওয়ার গুঞ্জন। এমন অবস্থায় নেটফ্লিক্স প্রতিবছর অতিরিক্ত ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই সঙ্গে দেওয়া হলো গেমিং চালুর ঘোষণা।
ভিডিও গেমসের ব্যবসাও বিশাল। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান পিডব্লিউসি বলছে, বিশ্বব্যাপী ভিডিও গেমসের ব্যবসায় আয় হয় বছরে ১৮০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। বিশ্ব বিনোদনের ব্যবসায় গেমসের ভাগ ২০১৯ সালে ছিল ১৫ শতাংশ। আর এ বছরে তা দাঁড়িয়েছে ১৯ শতাংশে। এবার তাতেই ভাগ বসাতে চাইছে নেটফ্লিক্স। এই নতুন বিভাগের প্রধান হিসেবে ফেসবুকের সংশ্লিষ্ট খাতের সাবেক প্রধান মাইক ভেরদুকে নিয়োগ দিয়েছে নেটফ্লিক্স। শোনা যাচ্ছে, এ খাতে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে মাইক্রোসফটের সঙ্গে চুক্তিও করতে পারে প্রতিষ্ঠানটি। কারণ, বিল গেটসের মাইক্রোসফটের আছে ক্লাউড-গেমিং প্রযুক্তি ও গেমস স্টুডিও।
কিন্তু গেমিংয়ের ব্যবসায় আসলে কতটুকু সুবিধা করতে পারবে নেটফ্লিক্স? চলতি বছরের জুন শেষে পাওয়া হিসাবে দেখা গেছে, এই ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মটির বর্তমান গ্রাহকসংখ্যা প্রায় ২১ কোটি। এই বিশাল গ্রাহক সম্প্রদায়ই নেটফ্লিক্সের প্রধান শক্তি। নেটফ্লিক্স যেভাবে শুধু ভিডিও কনটেন্ট দিয়েই ব্যবসা করে থাকে, অন্যান্য স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের আয় সেভাবে একক উৎসনির্ভর নয়। ডিজনির যেমন আয়রন ম্যান চরিত্রের আদলে তৈরি খেলনা বিক্রির সুযোগ আছে। আছে থিম পার্কের ব্যবসাও। ঠিক একইভাবে আয়ের উৎস বাড়াতে চাইছে নেটফ্লিক্স। জানা গেছে, ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’, ‘নারকোস’সহ প্রচারিত বিভিন্ন জনপ্রিয় সিরিজ বা সিনেমার আদলে গেমস তৈরি করতে চায় নেটফ্লিক্স।
বিশ্লেষকদের পূর্বাভাস, বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে নেটফ্লিক্সের গ্রাহকসংখ্যা ৫০ কোটির মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলতে পারে। অবশ্য গেমিং চালুর মাধ্যমে নেটফ্লিক্স যদি নিজেদের ব্যবসার গতি আরও বাড়াতে পারে, তবে আরও আগে মাইলফলক ছোঁয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এবার গেমিং খাতে নেটফ্লিক্স কতটা আগ্রাসীভাবে এগোয়, সেটিই এখন দেখার।
কোন মন্তব্য নেই