রুশ বিমান বাহিনীর হলোটা কী? ব্যাখ্যা পাচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র
ইউক্রেইনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর আগে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা পূর্বাভাস ছিল, মস্কো যুদ্ধ বিমানের বিশাল বহর নিয়ে তড়িৎবেগে ইউক্রেইনের আকাশ দখল করে নেবে।
কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর সাত দিনেও তেমন কোনো ইঙ্গিত দেখা যায়নি, বরং রাশিয়া তাদের বিমান বাহিনীকে খুব সতর্কভাবে ব্যবহার করছে, এতটাই সতর্কভাবে যে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা এর কোনো ব্যাখ্যা পাচ্ছেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, “তারা (রাশিয়া) আসলে প্রয়োজন ছাড়া তাদের বিমান এবং পাইলটদের নিয়ে অতিরিক্ত ঝুঁকি নিতে চাইছে না।”
সংখ্যা ও ক্ষমতার দিক থেকে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর তুলনায় নগন্য হওয়ার পরও ইউক্রেনীয় বাহিনীর বিমানগুলো এখনও উড়ছে এবং তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এখনও সক্রিয় আছে বলেই সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। বিষয়টি তাদের ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে।
২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেইনে আক্রমণ শুরুর পর বিশেষজ্ঞদের ধারণা ছিল রুশ বাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে ইউক্রেইনের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেবে। রাশিয়ার সংবাদমাধ্যমও তেমন দাবিই করেছিল।
লন্ডন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আরইউএসআই ‘রুশ বিমান বাহিনীর রহস্যময় অনুপস্থিতি’ শিরোনামে এক নিবন্ধে লিখেছে, “ইউক্রেইনের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়াই যৌক্তিক এবং সবচেয়ে অনুমিত পদক্ষেপ ছিল। ১৯৩৮ সালের পর প্রতিটি সামরিক অভিযানের ক্ষেত্রেই এ কৌশল অনুসরণ করা হয়েছে।”
অথচ ইউক্রেইনের বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলো এখনও স্বল্প পরিসরে প্রতিরক্ষামূলক পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। আর রাশিয়া এখনও শুধু লড়াইয়ের এলাকায় বিমান পাঠাচ্ছে।
ইউক্রেইনের বাহিনীর কাছে ভূমি-থেকে-আকাশে ছোড়ার রকেট রয়েছে যা রুশ বিমানের জন্য হুমকি হতে পারে এবং রুশ সেনাবাহিনীকে সহায়তা করতে গেলে ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটে রুশ সামরিক বিশেষজ্ঞ রব লি বলেন, “তারা এমন অনেক কিছু করছে যা ধাঁধায় ফেলে দিচ্ছে।”
তিনি ধারণা করেছিলেন, যুদ্ধের শুরুতেই সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে আঘাত হানবে রাশিয়া। কারণ যুদ্ধ যত বেশি দিনে গড়াবে, খরচ আর ঝুঁকি তত বাড়বে। তাহলে রুশ বাহিনী কেন শক্তি বাড়াচ্ছে না, তার কোনো যৌক্তিক কারণ তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না।
রাশিয়া যেভাবে তার বিমান বাহিনী ব্যবহার করছে, তা নিয়ে পশ্চিমাদের এই বিভ্রান্তির মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের জো বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেইনে ‘নো ফ্লাই জোন’ ঘোষণার আহ্বান নাকচ করে দিয়েছে।
রাশিয়ার বিমান হামলা ঠেকাতে ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ‘নো ফ্লাই জোন’ চেয়েছিলেন। কিন্তু ওয়াশিংটন তাতে সাড়া দেয়নি কারণ তাতে রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে যুক্তরাষ্ট্র এবং রুশ বিমানবাহিনীর উদ্দেশ্যও তাদের কাছে স্পষ্ট নয়।
ভূমিতে যুদ্ধে লিপ্ত রুশ সেনা বাহিনীর সঙ্গে বিমান বাহিনীর সমন্বয়ের অভাবও দেখতে পাচ্ছেন পশ্চিমা সামরিক বিশেষজ্ঞরা। বিমান বাহিনীর ছায়া থেকে এগিয়ে গিয়ে রুশ সেনাদের একাধিকবার ইউক্রেনীয় বাহিনীর অ্যামবুশের মধ্যে পড়তে দেখা গেছে।
এই সমন্বয়হীনতা রুশ সৈন্যদের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে, বিশেষ করে যখন ইউক্রেনীয় বাহিনী হাতে পেয়েছে তুরস্কের ড্রোন, ব্রিটিশ ও মার্কিন ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের মত নতুন নতুন অস্ত্র।
ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ‘নো ফ্লাইজ জোন’ কার্যকর করার দায়িত্বে ছিলেন মার্কিন বিমান বাহিনীর তিন তারকা জেনারেল ডেভিড ডেপটুলা। রাশিয়া কেন যুদ্ধ এলাকার আকাশে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জোরালো চেষ্টা নিচ্ছে না, তা নিয়ে তিনিও বিস্মিত।
তিনি বলেন, “রুশরা এখন বুঝতে পারছে যে বহুমাত্রিক অভিযানের সমন্বয় করাটা অত সহজ নয়। আর নিজেদের যতটা দক্ষ তারা দাবি করত, এ বিষয়ে তারা ততটা দক্ষও নয়।”
রাশিয়ার বিমানবাহিনীর বড় কোনো ভূমিকা যখন দেখা যাচ্ছে না, তখন ইউক্রেইনের বাহিনীর তাদের প্রত্যাশ্যার চেয়েও বেশি সাফল্য পাচ্ছে।
গত আট বছরে দেশের পূর্বাঞ্চলে রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে ইউক্রেইনের বাহিনীর যুদ্ধের যে অভিজ্ঞতা, তা মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ের ট্রেঞ্চ ভিত্তিক লড়াইয়ে সীমাবদ্ধ ছিল।
অন্যদিকে রাশিয়ার বাহিনী সিরিয়ায় সরাসরি যুদ্ধের প্রশিক্ষণ পেয়েছে। সেখানে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বাহিনীর সঙ্গে মিলে ফাইটার, ড্রোন ও স্থল বাহিনীর সমন্বিত হামলা পরিচালনার অভিজ্ঞতা তাদের হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আক্রান্ত হওয়ার পরও ইউক্রেইনের জেট ফাইটারগুলোর আকাশে উড়তে পারার মধ্য দিয়ে তাদের প্রতিরোধের একটি ধারণা পাওয়া যাচ্ছে, যা ইউক্রেইনীয় বাহিনী এবং জনগণের মনোবল বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এমনকি ইউক্রেইনের বৈমানিকদের বীরত্ব নিয়ে কিছু মিথও তৈরি হতে শুরু করেছে। একটি গল্পে বলা হচ্ছে, ইউক্রেইনের একজন পাইলট একাই ছয়টি রুশ ফাইটারকে ফেলে দিয়েছেন। তার নাম হয়ে গেছে ‘কিয়েভের ভুত’।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার স্টেট অব দি ইউনিয়ন ভাষণে ইউক্রেইনের পাশের থাকার অঙ্গীকার জানিয়ে তাদের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। আর রাশিয়াকে নিয়ে টিপ্পনি কেটে বলেছেন, পুতিন হয়ত ভেবেছিলেন এক গড়ান দিয়েই বিনা বাধায় ইউক্রেইনে ঢুকে পড়বেন।
“তার বদলে এখন তিনি প্রতিরোধের এক দেয়ালের সামনে পড়েছেন, যেটা তিনি ভাবতেও পারেননি। তিনি ইউক্রেইনের জনগণের মুখোমুখি হয়েছেন।”
যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তার হিসাবে রাশিয়া ইউক্রেইন অভিযানে এ পর্যন্ত ৭৫টির মত যুদ্ধবিমান ব্যবহার করেছে। অথচ অভিযান শুরুর আগে তাদের ধারণা ছিল, রাশিয়া হয়ত একসাথে কয়েকশ যুদ্ধবিমান ওড়াবে।
তবে আর কতগুলো রুশ যুদ্ধবিমান এবং সামরিক হেলিকপ্টার এখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত আছে, সে বিষয়ে কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। ইউক্রেইনের যুদ্ধে দুই পক্ষেই ক্ষতি হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওই কর্মকর্তা বলেন, “আমরা ধারণা পেয়েছি যে তারা (রাশিয়া) কিছু বিমান হারিয়েছে, ইউক্রেইনও বিমান হারিয়েছে। প্রতিদিনই সেখানে আকাশের নিয়ন্ত্রণ নিতে লড়াই চলছে।”
কোন মন্তব্য নেই