তারল্য সংকটের প্রভাব কৃষিঋণের লক্ষ্যমাত্রা থেকে পিছিয়ে আছে ৩৩ ব্যাংক
কৃষি দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হলেও এ খাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ কমে যাচ্ছে।-খবর কালের কণ্ঠ
বিশেষ করে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) কৃষি খাতে দেশের সব তফসিলি ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রার ৪৫ শতাংশেরও কম ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে মাত্র ৩৯ শতাংশ। এ সময়ে বিদেশি খাতের দুটি ব্যাংক কৃষকদের কোনো ঋণই বিতরণ করেনি। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের আরো তিনটি ব্যাংকের ঋণ বিতরণ ১ শতাংশেরও কম। সব মিলে ৩৩টি ব্যাংক কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এ তথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারল্য সংকটের কারণে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ কমে গেছে। এ ছাড়া অন্যান্য খাতের তুলনায় কৃষিঋণে সুদহার কম হওয়ায়ও ব্যাংকগুলো এ খাতে ঋণ বিতরণে অনাগ্রহ দেখায়।
জানা গেছে, শিল্প খাতসহ অন্যান্য খাতে ব্যাংকগুলো নিজেদের মতো করে সুদহার নির্ধারণ করলেও কৃষিঋণের সুদহার নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংকগুলো কৃষিঋণে ৯ শতাংশের বেশি সুদ নিতে পারে না, যে কারণে কৃষিতে ঋণ বিতরণে অনীহা দেখাচ্ছে বেসরকারি ও বিদেশি অনেক ব্যাংক। এ ছাড়া সার্বিকভাবে দেশে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ আগের মতো বাড়ছে না। কৃষিঋণ বিতরণেও এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।
চলতি অর্থবছরের কৃষি ও পল্লী ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ২৪ হাজার ১২৪ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো ১০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা এবং বেসরকারি ও বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ১৩ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা বিতরণ করবে। ঋণ বিতরণ বাড়াতে এবার নীতিমালায় কাজু বাদাম ও রামবুটান চাষ, কচুরিপানার ডাবল বেড পদ্ধতিতে আলু চাষ, ছাগল, ভেড়া, গাভি পালন, গরু মোটাতাজাকরণ, বাণিজ্যিকভাবে রেশম উৎপাদনে ঋণ প্রদানের কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশি-বিদেশি ৪৬টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ছয় মাসে কৃষিঋণ বিতরণ করার কথা ছিল ছয় হাজার ৮৭৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে পাঁচ হাজার ৩৭২ কোটি ১৪ লাখ টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এক হাজার ৫০২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বা ২২ শতাংশ কম। তবে সরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। সরকারি আট ব্যাংক পাঁচ হাজার ১৮৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বিতরণ করেছে পাঁচ হাজার ৪২৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।
প্রতিবেদনে আরো দেখা যায়, বিদেশি খাতের উরি ব্যাংক ও কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন গত ছয় মাসে এক টাকারও কৃষিঋণ বিতরণ করেনি। আর শুরু করলেও নামমাত্র কৃষিঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংক আল-ফালাহ, সিটি ব্যাংক ও সীমান্ত ব্যাংক। এসব ব্যাংকের কৃষিঋণ বিতরণের হার ১ শতাংশের নিচে। এ ছাড়া লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কৃষিঋণ কম বিতরণ করেছে এমন ব্যাংকের তালিকায় রয়েছে আরো ২৮টি ব্যাংক। তবে এ সময়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি কৃষিঋণ বিতরণ করেছে বেশ কিছু ব্যাংক। সরকারি খাতের বিডিবিএল ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, বেসরকারি খাতের ইস্টার্ন ব্যাংক ও ব্যাংক এশিয়া এবং বিদেশি খাতের হাবিব ব্যাংক ও স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ঋণ বিতরণে অনেক এগিয়ে রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিতরণ করা মোট ঋণের ২.৫ শতাংশ পল্লী অঞ্চলে বিতরণ করতে হবে। ব্যাংকগুলোর নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলে অনর্জিত লক্ষ্যমাত্রার সমপরিমাণ অথবা বিকল্পভাবে অনর্জিত লক্ষ্যমাত্রার ৩ শতাংশ হারে হিসাবায়নকৃত অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। এই অর্থের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো সুদ দেবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যাংকগুলো মোট ২৩ হাজার ৬১৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণ করেছে, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ১০৮.৩৩ শতাংশ ছিল। অন্যদিকে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ও তারল্য সংকটের কারণে দীর্ঘদিন ধরেই বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। এটি গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
কোন মন্তব্য নেই