‘পেট তো লকডাউন হয় না’ - TIMES EXPRESS | টাইমস এক্সপ্রেস is an interactive news portal

নিউজ ফাস্ট

‘পেট তো লকডাউন হয় না’












তপ্ত দুপুর। রোদে ঘাম ঝরছে। তার পরও পেটের তাগিদে যাত্রীর খোঁজে চুয়াডাঙ্গা শহরের সাতগাড়ী গ্রামের রিকশাচালক আকমল হোসেনের অপেক্ষা। আকমল জানালেন, এক ঘণ্টা হলো এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছেন। একজন যাত্রীও পাননি। রাস্তাঘাট ফাঁকা। এক টাকাও আয় হয়নি। সকালে কত হয়েছিল প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘সকাল থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত মাত্র ১০০ টাকা হয়েছে। তাতে তো সংসার চলবে না।’

গাজীপুর সদর উপজেলার বাঘের বাজারে একটি বহুতল ভবনে কাজ করেন নির্মাণ শ্রমিক চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা বিল্লাল হোসেন। চোখে-মুখে রাজ্যের হতাশা নিয়ে বিল্লাল বলেন, ‘আমার অধীনে কাজ করে ১৫০ থেকে ১৬০ শ্রমিক। করোনার প্রভাবে নিত্যপণ্য, ওষুধ ও খাবারের দোকান ছাড়া সব দোকান বন্ধ। তাই রড-সিমেন্টর অভাবে ভবনের কাজ বন্ধ। আমরা দিন আনি দিন খাই। কাজ না থাকায় ধারদেনা করে দুই-তিন দিন ধরে সংসার চালাচ্ছি। সামনে কিভাবে স্ত্রী-সন্তানের মুখে খাবার দেব, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’

‘সকাল থাকি দুপুর পর্যন্ত রিকশা চালে কামাই হইছে ৪০ টাকা। মোর সংসার চালাইতে প্রত্যেক দিন লাগে ৩০০ টাকা। ছয় দিন ধরি কামাই না হয়ায় ধার করিনু ১৮০০ টাকা। আজিকার দিনটাও ধার-হাওলাদ করি সংসার চালেবার লাগিবে। কাইল কি হইবে কবার পারেছ না।’ কথাগুলো বলছিলেন নীলফামারীর ইটাখোলা ইউনিয়নের হাতীবান্ধা গ্রামের জামিরুল ইসলাম। মা, স্ত্রী আর দুই সন্তানসহ ছয় সদস্যের পরিবার চালাতে জেলা শহরে তাঁকে বেছে নিতে হয়েছে রিকশা চালানোর পেশা। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে মানুষ ঘরবন্দি হওয়ায় আয়ের অভাবে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তাঁর পরিবারে।

করোনাভাইরাসের প্রভাবে এখন এভাবেই কর্মহীন দেশের লাখ লাখ শ্রমজীবী মানুষ। নির্মাণশিল্পে বালু, ইট, পাথর পরিবহন, বাজারে মালামাল লোড-আনলোড, সড়ক নির্মাণ কাজে জড়িত লাখ লাখ শ্রমজীবী। রয়েছে বিভিন্ন যানবাহনের চালক। সবাই এখন কর্মহীন। জেলা-উপজেলার অলিগলি, বাসস্ট্যান্ড ও বাজারে চা বিক্রি করে সংসার চালাত বহু মানুষ। তাদের একটি বড় অংশ ছিল নারী। কর্মহীন হয়ে সংসার নিয়ে ভাবনায় পড়েছে তারাও। কাজকর্ম না থাকায় পরিবারের সদস্যদের মুখে আহার দিতে না পেরে দিশাহারা শ্রমজীবীরা।

ফরিদপুর জেলাজুড়ে কর্মহীন হয়ে পড়েছে শ্রমিক ও দিনমজুর। গত তিন দিন জেলা থেকে শুরু করে উপজেলা সদরের বেশির ভাগ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। শহরগুলোতে জনসাধারণের চলাচলও সীমিত করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে শহরের জনতা ব্যাংক মোড়, প্রেস ক্লাব চত্বর, আলীপুর মোড়, থানা মোড়, ভাঙ্গা রাস্তার মোড়ে গিয়ে দেখা গেছে ব্যস্ততম এ এলাকাগুলো একেবারেই ফাঁকা। এদিকে গতকাল সকাল ১১টা থেকে ফরিদপুরে টহল দিতে শুরু করে সেনাবাহিনী।

ঝালকাঠি শহরের মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে অটোরিকশা, ম্যাজিক গাড়ি ও মহেন্দ্র চলাচল। সীমিত করা হয়েছে রিকশাসহ হালকা যান চলাচল। এ ছাড়া নির্দিষ্ট কিছু দোকান ছাড়া সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কর্মহীন হয়ে পড়েছে শ্রমজীবী মানুষ। দিনমজুররাও কাজ না পেয়ে সংসার চালানোর দুশ্চিন্তায় ভুগছে।

ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী বলেন, ‘আমাদের কাছে ২০০ মেট্রিক টন চাল ও পাঁচ লাখ টাকা রয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে এগুলো মানুষের মাঝে বিতরণ করা হবে। আশা করি, কেউ না খেয়ে থাকবে না।’






হবিগঞ্জে বন্ধ হয়ে গেছে পাঁচ হাজার ব্যাটারিচালিত ইজি বাইক। শহরতলির বহুলা গ্রামের ইজি বাইকের চালক ইদ্রিছ মিয়া জানান, যারা টমটম চালায় তারা প্রতিদিন মালিককে ৪০০ টাকা দেওয়ার পর যা আয় হয় তা দিয়ে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করে। কিন্তু টমটম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন তাদের কোনো আয়-উপার্জন নেই।

রংপুরের পীরগাছার বিপণিবিতানসহ দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে ওষুধের দোকান, কাঁচাবাজার ও মুদি দোকান খোলা রয়েছে। উপজেলা সদর বাজারে প্রায় জনশূন্য রাস্তায় ভ্যান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মোফাজ্জাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘কামাই না করলে তো করোনার আগে না খায়া মারা যামো। এক দিন ভ্যান চলে কামাই না করলে হাঁড়ি চুলাত উঠে না। তাহলে হামার ভয় করি কী লাভ। আগে যে কামাই হছিলো এখন তার অর্ধেক কামাই হয় না। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা।’

এর মধ্যেও ভিন্নচিত্র চোখে পড়ে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁর পিরোজপুর ইউনিয়নের প্রতাপনগর গ্রামে। দেখা যায়, স্থানীয় নুরুদ্দিন মিয়ার দোতলা বাড়ির ছাদ ঢালাইয়ের কাজ চলছে। প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ জন নির্মাণ শ্রমিক কোনো রকম নিরাপত্তাব্যবস্থা ছাড়াই ছাদ ঢালাইয়ের কাজ করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শ্রমিক বলেন, ‘বাবা রে, পেট তো আর লকডাউন হয় না। কাজ না করলে খামু কী? পরিবারের সবাই অনাহারে মারা যাবে। সবাই শুধু মুখোশ আর হাত ধোয়ার ওষুধ দেয়, পেটে দেওয়ার মতো খাবার তো কেউ দেয় না।’

সূত্র : কালেরকণ্ঠ 

কোন মন্তব্য নেই