রেলগাড়ি মালগাড়ি ও ঔপনিবেশিক অর্থনীতি - TIMES EXPRESS | টাইমস এক্সপ্রেস is an interactive news portal

নিউজ ফাস্ট

রেলগাড়ি মালগাড়ি ও ঔপনিবেশিক অর্থনীতি




মূল্যবৃদ্ধি-সংক্রান্ত ১৯১৫ সালের ভারতীয় পর্যবেক্ষক দলের প্রতিবেদন থেকে কিছুটা উদ্ধৃতির অনুবাদ অপ্রাসঙ্গিক হবে না:


ভারতবর্ষে রেলওয়ের আগমন কৃষকদের জন্য বিশেষ সুবিধা লাভের কারণ হয়েছে। বড় ধরনের উৎপাদনশীল অঞ্চলে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় বিকল্প বাজার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উৎপাদনকারী এখন সরাসরি পাইকারি বিক্রেতা ও দালালের মুখোমুখি হতে পারছে। আগে গ্রামের কোনো দোকানদার উৎপাদককে তার সুবিধা অনুযায়ী দাম দিয়ে কিনে বাজারে নিয়ে উচ্চমূল্যে বিক্রয় করত। তাদের দৌরাত্ম্য এখন আর নেই। গ্রামের উৎপাদনকারী এখন বাজারের পৃথিবীর সংস্পর্শ পাচ্ছে, ব্যবসায়ের পদ্ধতি শিখেছে এবং তার অঢেল উৎপাদনের লাভ করে নিতে পারছে। রেলওয়ে সূচিত হবার আগে লাভ ছিল সামান্য, বাজার ছিল ক্ষুদ্র এলাকাতে সীমাবদ্ধ আর যোগান ছিল চাহিদার অতিরিক্ত। কোনো কোনো বছর ফসল ভালো হলে দাম পড়ে যেত, বেশি ফসলের লাভ ঘরে তুলতে পারত না বরং ফসলের একাংশ মাঠ থেকে না তোলাই লাভজনক হয়ে পড়ত। রেলওয়ে এই পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছে। রেলওয়ের কারণেই কৃষক উদ্বৃত্ত এলাকার উৎপাদন ঘাটতি এলাকায় সরবরাহ করতে সক্ষম হচ্ছে।


জার্মান অর্থনীতিবিদ ফ্রেডরিখ লিস্ট (১৭৮৯-১৮৪৬) রেলওয়ের অর্থনৈতিক অবদান নিয়ে লিখেছেন। সাধারণত পরিবহনে যে ব্যয় হয়ে যাবে তার অর্ধেকের চেয়ে কম নিয়ে রেলওয়ে কাঠ, ঘাস ও কয়লা পরিবহন করে থাকে। কোরিয়ায় ময়দা, মাংস ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রীর দাম লিপজিগের চেয়ে পঞ্চাশ থেকে শতভাগ কম। কাজেই উদ্বৃত্ত অংশ এজবার্জ, এলব ও হেনসেটের শহরে রফতানি করতে পারবে। সস্তা খাবার ও জ্বালানি শ্রমিক শ্রেণীর কল্যাণ আংশিক নিশ্চিত করতে পারবে। অবশ্য তাতে শ্রম মজুরি কিছুটা হেরফের হলেও নির্মাণকাজ বেড়ে যাবে, শহরের ভেতরে ও বাইরে বাসস্থানের ভাড়াও কমবে। আমি এক মুহূর্তের জন্যও রেলওয়ের লাভজনক অর্থনীতি নিয়ে সন্দিহান নই। কেবল লিপজিগে যে মূল্যযোগ ঘটবে তাতেই কয়েক বছরের মধ্যে রেলওয়ের মোট বিনিয়োগের সবটাই উঠে আসবে।


রেলওয়ে কেমন করে অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছে, তার একটি সাধারণ বিবরণ তুলে ধরা হচ্ছে:


প্রযুক্তি ব্যবসাবান্ধব: যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে উন্নততর প্রযুক্তি সমর্থিত রেলওয়েতে পরিবহন খররে আশাতীত হ্রাস ঘটেছে। ফলে পণ্যের দাম ভেঙে মাইক্রোকম্পিউটার ইন্টারনেট একালের অর্থনীতিকে যতটা প্রভাবিত আছে রেলওয়ে তার বাণিজ্যিক যাত্রার শুরুতে অর্থনীতি তার চেয়েও বেশি প্রভাবিত হয়েছিল।


আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ‘থিওরি অব কম্পারেটিভ অ্যাডভান্টেজ’ বা তুলনামূলক সুবিধাতত্ত্ব রেলওয়ে প্রয়োগ ও প্রতিষ্ঠা করেছে। যেমন বাংলার তুলনামূলক সস্তা উৎপাদন পাট ম্যানচেস্টারে রফতানি হয়েছে, লিপজিগ ব্যাভারিয়া থেকে ট্রেনে খাদ্যসামগ্রী আমদানি করেছে।


উন্নয়নের একটি বড় মাপকাঠি সেবা ও দ্রব্যসামগ্রীর পথের পরিধি বৃদ্ধি পাওয়া। ব্রিটেনে ‘ফিস অ্যান্ড চিপস’ সার্বজনীন খাবারে পরিণত হয় রেলওয়ে যোগাযোগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে। বাংলায় বহু মালিগাড়ি পাটের গাড়ি হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিল।


রেলওয়ের নতুন ভ্রমণকারীও বাড়তি বাণিজ্য সৃষ্টি করেছে। শুরুতে মনে করা হয়েছিল রেলওয়ে আসলে সড়ক ও নৌপথের যাত্রীদের হরণ করবে, বাস্তবে এ পরিমাণ অত্যন্ত কম। রেলওয়ে নিজের যাত্রী সৃষ্টি করেছে। যে ব্যবসায়ী তার মালামালসহ বারো-চৌদ্দ ঘণ্টা সড়কপথে বাণিজ্য গন্তব্যে মাসে একবার যেতেন, রেলওয়েতে দুই ঘণ্টায় সে পথ অতিক্রম করা যায় বলে তিনি মাসে দশবার আসা-যাওয়া করছেন। বাড়তি নয়বারের জন্য তিনি ছিলেন সুপ্ত যাত্রী—রেলওয়ে তাকে উৎস থেকে বের করে এনেছে। তার ১০ বার যাওয়া-আসার গন্তব্যস্থলে গড়ে উঠেছে আবাসিক হোটেল, রেস্তোরাঁসহ বহুবিধ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান।


সহজলভ্য কাঁচামাল নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠার প্রেরণা দিয়েছে। এ কৃতিত্ব রেলওয়ের। অনেক ট্রেনের নামই ছিল মেইল ট্রেন। চিঠিপত্র ও পার্সেল বিতরণ রেলওয়ের কারণে সহজতর ও নিয়মিত হয়ে উঠেছিল। গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়ন শব্দটি প্রতিষ্ঠা পাওয়ার শত বছর আগে রেলের মাধ্যমে বিশ্বায়ন সাধিত হয়েছে।

লন্ডনে বসে ভারত থেকে রেল ও সমুদ্রপথে আসা চা, ব্রাজিল থেকে আসা মাংস, পানাম থেকে আসা কলা, ফ্রান্স থেকে আসা ওয়াইন দিয়ে ভোজনের সুযোগ সৃষ্টি করেছে রেলওয়ে।


দুই মহাযুদ্ধেরই সৈন্য ও অস্ত্র পরিবহনের প্রধান মাধ্যম ছিল রেলওয়ে। যুদ্ধকালে রেলওয়ের ভূমিকা একই সঙ্গে আগ্রাসী ও প্রতিরক্ষামূলক।


ভারতবর্ষে ও আফ্রিকায় রেলগাড়ি আসে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকের উদ্যোগে। উদ্দেশ্য কতটা জনকল্যাণ আর কতটা নিজ দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ করা—এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও মূল উদ্দেশ্য যে ঔপনিবেশিক শাসন সংহত করা এবং প্রতিযোগী ইউরোপীয় দেশের ছোবল প্রতিহত করা এ নিয়ে সন্দেহ নেই।


এটা স্বীকৃত যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে ভারতে রেলের যে বিস্তৃত নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে পৃথিবীর অন্য কোনো উপনিবেশে কোনো নিয়ন্ত্রক দেশ এতটা পারেনি। বলা হয়ে থাকে রেলওয়ে ছিল ভারতে ব্রিটিশরাজের রক্ত সঞ্চালক ধমনি, যা ভারতের প্রায় সবাইকে কোনো না কোনোভাবে স্পর্শ করেছে। জনবসতি, মন্দির, দুর্গ, বাজার—রেলওয়ে সবকিছুকেই ছুঁয়ে গেছে।


ভারতে ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিকীকরণের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা চিহ্নিত ও মূল্যায়িত হয়ে আসছে। তুলনামূলকভাবে অনেক কমসংখ্যক সৈন্যের একটি বহর নিয়ে বিচিত্র চরিত্রের এমন একটি বিক্ষুব্ধ সাম্রাজ্য এত দীর্ঘ সময় শাসনের মূলমন্ত্রই ছিল যেখানে প্রয়োজন সেখানে যেন সৈন্য মোতায়েন করা যায়। শুরুটা মন্থর গতির হলেও লর্ড ডালহৌসি যে বিস্তৃত নেটওয়ার্ক কল্পনা করেছিলেন, ১৮৫৭-এর সিপাহি বিদ্রোহের বড় ধাক্কার পর দ্রুত রেলওয়ে নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করা হয়। ভারতীয়দের বেলায় রেলের তৃতীয় শ্রেণী নির্ধারণ, এটিও ঔপনিবেশিক শাসন কৌশলের অন্যতম। ব্রিটিশদের রেলনীতি নিয়ে ক্রিশ্চিয়ান ওলমার একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন রেলওয়েজ অ্যান্ড দ্য রাজ।ভারতের রেলওয়ে—ব্রিটিশ উপহার!


ভারতে প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন এবং তারও আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুরাচারবৃত্তি ও লুণ্ঠন প্রশ্নে যারা কেবলই অ্যাপোলজিস্ট তারা মনে করেন ভারতকে দেয়া রেলওয়ে ব্রিটেনের শ্রেষ্ঠ উপহার। শশী থারুর তা মানতে নারাজ। রেলওয়ে নির্মিত হয়েছে ভারতের টাকায় ব্রিটিশের পরিকল্পনায় তাদেরই স্বার্থে, শাসন লুণ্ঠন সহজ ও পদ্ধতিগত নিরাপদ করতে। ত্বরিত ও উন্নততর যোগাযোগ একমাত্র রেলওয়ের পক্ষে প্রদান করা সম্ভব ছিল। রেলওয়ে প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা ব্রিটিশ সরকারের কাছে তুলে ধরতে গভর্নর জেনারেল লর্ড হেনরি হার্ডিঞ্জ (১৭৮৫-১৮৫৬) ১৮৪৩ সালে বলেছিলেন, বাণিজ্য, সরকার, সামরিক নিয়ন্ত্রণের জন্য তা করা আবশ্যক। রেলওয়ের মাধ্যমে ভারতীয় কয়লা খনিজ লৌহ, তুলা ও অন্যান্য দ্রব্য বন্দরে ব্রিটিশ জাহাজে তুলে দেয়া হবে।


হেনরি হার্ডিঞ্জের দ্বিতীয় পুত্র চার্লস হার্ডিঞ্জও ভারতে ব্রিটেনের ভাইসরয় ছিলেন। ১৯১৫ সালে উদ্বোধন করা পদ্মার ওপরের হার্ডিঞ্জ রেলওয়ে সেতুটি তারই নামে।


পার্থ ভার্মার বিশ্লেষণ অনুযায়ী রেলওয়ের মাধ্যমে ভারতের যতটা  আধুনিকায়ন হয়েছে বলে মনে করা হয় তা কখনো পূর্বপরিকল্পিত নয়। ব্রিটেনের উদ্বৃত্ত পুঁজি থেকে নিশ্চিত ও পর্যাপ্ত মুনাফা প্রাপ্তি ঘটবে বোঝার পরই কাঁচামাল বিশেষ করে তুলা দূরবর্তী স্থান থেকে স্বল্প ব্যয়ে পরিবহন করে নিজ দেশে তৈরি পোশাক ও কাপড়ের বাজার সম্প্রসারণ করতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়। ভারতের রেলওয়ের জন্য ব্রিটেনে লৌহ ও ইস্পাত শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। যে উদ্যোগ ভারতে একটি শিল্প বিপ্লব ঘটাতে পারত কিন্তু তা না হয়ে ক্ষুদ্র আকারে বাণিজ্যিক বিপ্লব ঘটেছে। ভারতে রেলওয়ে সম্প্রসারণ ও টেলিগ্রাফ সম্প্রসারণের মূল লক্ষ্য ঔপনিবেশিক শাসন সংহত ও লাভজনক করে তোলা—ভারতবর্ষের যে লাভটুকু হয়েছে তা মূল লক্ষ্যের উপজাত বাইপ্রডাক্ট।


এমনকি ইংরেজ গবেষকরাও মনে করছেন কোনো বৃহৎ  দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে রেলওয়ের কথা ভাবা হয়নি।  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে রেলওয়ের অগ্রগতি ছিল মন্থর কিন্তু ১৮৫৭-এর সিপাহি বিদ্রোহ এ কাজ ত্বরান্বিত করে।


ব্রিটিশদের গিফট হোক কি নিজ স্বার্থে করা হোক কার্ল মার্ক্স এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন, কারণ আধুনিক ও উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা ভারতে বুর্জোয়া উত্থানের পথ সুগম করে দেবে। আর তা-ই হবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পাটাতন। (আগ্রহী পাঠক ড্যান বোগার্ট ও লতিকা চৌধুরীর রেলওয়েজ অ্যান্ড দ্য ওয়াটার রেজিম অব ইস্টার্ন বেঙ্গল ডেল্টা ১৮৪৫-১৯৪৩ এবং শশী থারুরের ইনগ্লোরিয়াস এম্পায়ার পড়তে পারেন)



কোন মন্তব্য নেই