কেন ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি বিশ্বজুড়ে যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়ায়
নাগর্নো-কারাবাখ আর্মেনিয়ার একটি বিতর্কিত ছিটমহল। এর বাসিন্দাদের বেশিরভাগই (খ্রিস্টান) আর্মেনিয়ান। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার সময় (মুসলিম) আজারবাইজান থেকে বের হয়ে যায় অঞ্চলটি। আর্মেনিয়া তাদের সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু এই অঞ্চল আর আর্মেনিয়ার মাঝখানে ছিল আজারবাইজানের বিপুল পরিমাণ জমি। এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নাগর্নো-কারাবাখ ছাড়াও মাঝের ওই জমি দখলে নেয় আর্মেনিয়া। সেই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিল লাখো মানুষ। বাস্তুচ্যুত হয়েছিল সম্ভবত ১০ লাখের বেশি। ১৯৯৪ সালে দুই পক্ষের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। তবে এরপরও নানা সময়ে দুই দেশের মধ্যে ভূখন্ডটি নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। তবে নিশ্চিতভাবেই, সাম্প্রতিক সংঘাতটিই যুদ্ধবিরতির পর সবচেয়ে গুরুতর।
আজারবাইজান ফের তাদের ভূখন্ড জোরপূর্বকভাবে ফিরিয়ে নিতে চাইছে। এ সংঘাতে আজারবাইজানকে সমর্থন দিচ্ছে তুরস্ক। দেশটির সঙ্গে তুরস্কের জাতিগত ও সাংস্কৃতিক ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। অন্যদিকে, আর্মেনিয়ার সঙ্গে একটি সামগ্রিক-নিরাপত্তা চুক্তি রয়েছে রাশিয়ার।
তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়্যিপ এরদোগান এই সংঘাতকে দেখছেন, নিজেকে আঞ্চলিক সুপ্রিম লিডার ও মুসলিমদের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ হিসেবে। যেমনটা তিনি আগ থেকেই সিরিয়া ও লিবিয়ায় করে আসছেন। তবে চুপচাপ রয়েছে রাশিয়া। যদিও তাদের এ অবস্থান বেশিদিন টিকবে বলে মনে হচ্ছে না। আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া- উভয় দেশকেই পাশ থেকে ঘিরে রেখেছে ইরান।
এছাড়া ইরানে আজেরি বা আজারবাইজানি তুর্কি সম্প্রদায়ের বড় জনসংখ্যা রয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে এ যুদ্ধে ইরান জড়িয়ে পড়তে পারে। ক্যাসপিয়ান সমুদ্র থেকে তাদের গ্যাসভর্তি পাইপলাইন যুদ্ধের সম্মুখ ময়দানে কাছ দিয়েই চলে গেছে।
নাগর্নো-কারাবাখ বিবাদ সমাধানের একটি রূপরেখার পক্ষে একদশকেরও বেশি সময় ধরে সমর্থন জানিয়ে আসছে বাইরের শক্তিগুলো। তাদের মতে, আজারবাইজান অঞ্চলটিকে বৈধভাবে স্বায়ত্ত্বশাসনের অধিকার দেবে। অঞ্চলটির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে এর বাসিন্দারাই। এর বদলে আর্মেনিয়া নব্বইয়ের দশকে আজারবাইজানের যেসব এলাকা দখল করেছিল সেগুলো ফিরিয়ে দেবে। কেবল নাগর্নো-কারাবাখের সঙ্গে একটি সরু করিডোর ধরে রাখবে। এক পর্যায়ে উভয় দেশের সরকারই এ সমাধানের প্রতি সম্মতি জানিয়েছিল। তবে এখন অবশ্য কোনো পক্ষই আর ছাড় দিতে রাজি নয়।
এখানে সকলের জন্য ট্র্যাজিডি হচ্ছে এ ধরনের সংকট সমাধানের পদ্ধতি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে, একটি বাধা হচ্ছে করোনা ভাইরাস। অতীতে, এ ধরনের আলোচনায় বিশ্বের বহু দেশ থেকে আলোচনাকারীরা অংশ নিতেন। আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ে আস্থা গড়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু করোনা মহামারী সেই ধরনের কূটনীতি কঠিন করে তুলেছে।
সবচেয়ে বড় সমস্যা অবশ্য বৈশ্বিক নেতৃত্বের অনুপস্থিতি। আমেরিকা ও রাশিয়া ১৯৯৪ সালের যুদ্ধবিরতি আনতে সহায়তা করেছিল। এছাড়া অতীতে অনেক বিষয়েই নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছিল এই দুই শক্তি। তবে যুক্তরাষ্ট্রে বারাক ওবামা ক্ষমতায় আসার পর ধীরে ধীরে ভেতরের দিকে গুটিয়ে যেতে থাকে দেশটি। পরবর্তীতে ডনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে আরব নেতাদের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্কোন্নতি ঘটানোয় ভূমিকা রাখে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রে এ মধ্যস্ততার প্রভাব ভালোই ছিল। কিন্তু দেশটি নিয়মিত শান্তিরক্ষার ভূমিকা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তুরস্ক ন্যাটো-মিত্র। অতীতে হয়তো এই মিত্রতার জের ধরে এরদোগানকে আজারবাইজান-আর্মেনিয়ার সংঘাতে হস্তক্ষেপ না করার আহ্বান জানানো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সম্ভব ছিল। হয়তো যুদ্ধ থামানোর জন্য চাপ দিতে পারতো তারা। কিন্তু ট্রাম্পের হাতে ন্যাটোর জন্য সময় নেই। আর আমেরিকা ছাড়া ন্যাটো স্রেফ রাডারহীন একটি সংস্থা। ট্রাম্পের আগের প্রেসিডেন্টরা ন্যাটোর পেছনে সময় দিতেন। ককেশাসে যুদ্ধ থামানোর জন্য শ্রম দিয়েছিলেন তারা। কিন্তু ট্রাম্প ন্যাটো নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহই দেখাননি। অতীতের রাশিয়াও হয়তো এরদোগানকে থামানোর চেষ্টা করতো। কিন্তু ভ্লাদিমির পুতিন অনেকটা ট্রাম্পের মতো নিজের দেশীয় সমস্যা নিয়েই ব্যস্ত আছেন। এরদোগানের ছোটোখাটো দুষ্টুমিতে তিনি তেমন ক্ষতি দেখছেন না। মূলত, তুরস্কের সঙ্গে ন্যাটোর অন্যান্য সদস্যদের দূরত্ব সৃষ্টি করতে সক্ষম এমন যেকোনো কিছুই ক্রেমলিনের সহ্য করতে প্রস্তুত।
বিশ্বজুড়ে হিমায়িত সংঘাতের সংখ্যা অনেক। অনেক জায়গায় হয়তো এই মুহূর্তে ঠিক যুদ্ধ চলছে না, কিন্তু তাই বলে চাপা পড়া উত্তেজনাও প্রশমিত হয়নি। এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে ঐতিহাসিক ও ভূখন্ড-সংক্রান্ত বিবাদ বেশ গভীর আকার ধারণ করেছে। এমন চাপা থাকা সংঘাতের সমস্যা হচ্ছে, এগুলো যেকোনো সময় জ্বলে উঠতে পারে। বর্তমান বিশ্বে, যেখানে গণতান্ত্রিক সুপারপাওয়ারগুলো বিরক্ত ও অন্যমনস্ক অবস্থায় আছে, সেই বিশ্বে দূরের এসব যুদ্ধ এড়ানো আগের চেয়ে কঠিন হয়ে উঠছে।
কোন মন্তব্য নেই