করোনার ৬ মাসে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ৪ হাজার ৮৬৩
বিদায়ী বছরের করোনায় দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব পড়লেও ধনী হওয়ার সূচক ছিলো ঊর্ধ্বমুখী। এই ধারা চলতে থাকলে মানুষের আয়ের বৈষম্য আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। সরকারকে কোটিপতি বাড়ার কারণ খতিয়ে দেখতে বলছেন তারা।
২০২০ সালের মার্চে পর্যন্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কোটি টাকার বেশি আমানেেতর অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৬২৫। গত সেপ্টেম্বরের শেষে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৭ হাজার ৪৮৮। ব্যাংক খাতে কোটি টাকা আমানত রাখা অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বেড়েছে ৪ হাজার ৮৬৩টি। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডিজ (বিআইডিএস)-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ জানান, দেশে গরীবের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে কিনা এটার জন্য পরিসংখ্যানের প্রয়োজন হয় না। আমাদের চারপাশে অবস্থানকারি লোকদের দিকে থাকালেই বোঝা যায়। সরকারও বলেছে যে দেশে গরীবের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি জানান, ধনীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা উদ্বিগ্ন নই। আমরা চিন্তিত হচ্ছে গরিবের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়ে। আমরা চাই লিগাল ওয়েতে দেশে ধনীদের সংখ্যা বাড়–ক। কারণ দেশে ধনী বাড়লে অর্থনীতি বাড়ে। তবে দেখতে হবে তারা সঠিক পথে ধনী হয়েছে না অন্যভাবে হয়েছে। যদি তারা সরকারকে ট্যাক্স ও ভ্যাট দিয়ে ধনী হয় তাহলে ভালো। আর সরকারকে এই জায়গাটাই খতিয়ে দেখতে হবে।
এই অর্থনীতিবিদ আরও জানান, কেউ যদি অবৈধপথে অর্থ আয় করে ধনী হয় এটা গরীবের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। কারণ তাদের ট্যাক্স ও ভ্যাটের অংশ পরোক্ষভাবে গরীবরা পেয়ে থাকে। অর্থাৎ সরকার ধনীদের কাছ থেকে ট্যাক্স এবং ভ্যাট নিয়ে চিকিৎসা, শিক্ষাসহ বিভিন্ন সেবায় বিনিয়োগ করে থাকে। সেইসঙ্গে নানা ধরনের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি নিয়ে থাকে। এভাবেই ধনীদের টাকা গরীবের কাছে চলে যায়। গরীবের সংখ্যা বাড়লে আয় বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। যে দেশের সার্বিক উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ৮৭ হাজার ৪৮৮টির মধ্যে ব্যক্তি অ্যাকাউন্টও যেমন রয়েছে, তেমনই প্রাতিষ্ঠানিক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। আর প্রতিটি প্রাতিষ্ঠানিক অ্যাকাউন্টের পেছনে কোনও না কোনও ব্যক্তি রয়েছেন। তারা বলছেন, ব্যাংকে কোটি টাকার বেশি আছে, এমন আমানতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া মানেই দেশে নতুন করে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, নামে অথবা প্রতিষ্ঠানের নামে কোটি টাকার ওপরে আমানত রাখা অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বাড়া মানেই কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া। অতিধনীর বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেও এমন চিত্রই উঠে এসেছে।
জানা যায়, ২০১৮ সালে সম্পদশালী বৃদ্ধির হার ও ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রক্ষেপণ ধরে ওয়েলথ-এক্স এর প্রতিবেদনে বলা ছিল, ৩ কোটি ডলার বা ২৫০ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিকদের সংখ্যা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি হারে বাড়ছে। ওয়েলথ-এক্সের হিসাবে, ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে অতিধনীর সংখ্যা বেড়েছে গড়ে ১৭ শতাংশ হারে। এ হার যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, ভারতসহ মোট ৭৫ বড় অর্থনীতির দেশের চেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জুন থেকে সেপ্টেম্বর এ তিন মাসে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতের সংখ্যা বেড়েছে ১ হাজার ৪৫১টি। আর গত মার্চ থেকে জুন ওই তিন মাসে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে ৩ হাজার ৪১২ জন। এ বছরের জুন মাস শেষে ব্যাংক খাতে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ৮৬ হাজার ৩৭ জন। গত মার্চ শেষে এই সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৬২৫ জন।
অন্যদিকে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) করোনাকালীন এক প্রতিবেদনে বলেছে, করোনায় মানুষের আয় কমেছে ২০ শতাংশ। করোনার আগে গত মার্চ মাসে প্রতি পরিবারের মাসিক গড় আয় ছিল ১৯ হাজার ৪২৫ টাকা। আগস্টে তা কমে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৪৯২ টাকায়। অর্থাৎ পাঁচ মাসের ব্যবধানে পরিবারপ্রতি আয় কমেছে প্রায় চার হাজার টাকা। আর জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের সহযোগিতায় প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ আয়োজিত এক ওয়েবিনারে জানানো হয়, কোভিড-১৯-এর কারণে আয় কমেছে শতকরা ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবারের। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে সেসব পরিবার, যাদের বছরে আয় এক লাখ টাকার কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত এক বছরে কোটিপতি আমানতকারী বেড়েছে ৭ হাজার ৭১১ জন। এর মধ্যে করোনাকালের ছয় মাসেই বেড়েছে ৪ হাজার ৮৬৩। ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ৭৯ হাজার ৮৭৭ জন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, বিগত ১২ বছর ধরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে। ২০০৯ সালের জুন মাস শেষে ব্যাংক খাতে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ৪৯২ জন। এখন এ সংখ্যা ৮৭ হাজার ৪৮৮ জন। অর্থাৎ গত ১২ বছরে ৬৫ হাজার ৯৯৬ ব্যাংকের গ্রাহক কোটিপতির তালিকায় নতুন করে নাম লিখিয়েছেন। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে ব্যাংকে ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা ব্যক্তি রয়েছেন এক হাজার ৩০৩ জন। ৪০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা ব্যক্তি রয়েছেন ৪৭২ জন। ৩৫ কোটি টাকার বেশি আমানত রেখেছেন ২৬৮ জন গ্রাহক। ৩০ কোটি টাকারও বেশি আমানত রেখেছেন ৩৫২ জন। ২৫ কোটি টাকার বেশি আমানত রেখেছেন ৬২৬ জন। ২০ কোটি টাকার বেশি আমানত রেখেছেন ১০৪০ জন। ১৫ কোটি টাকার বেশি আমানত রেখেছেন ১ হাজার ৫৭১ জন। ১০ কোটি টাকার বেশি আমানত রেখেছেন ৩ হাজার ২৩২ জন। পাঁচ কোটি টাকার বেশি আমানত রেখেছেন ৯ হাজার ৬৯৯ জন। এক কোটি থেকে ৫ কোটি টাকা আমানত রাখা গ্রাহকের সংখ্যা ৬৮ হাজার ৯২৫ জন গ্রাহক।
কোন মন্তব্য নেই