ফজরে ওঠার বারাকাহ
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো সালাত। যা স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে সরাসরি সম্পর্কের অন্যতম সেতুবন্ধন। বারাকার উৎস ফজরের সালাত আমাদের স্রষ্টার সন্তুষ্টি ও করুণা নিয়ে দিনের শুরু করতে সাহায্য করে। যার মাধ্যমে সারাদিন আমাদের দেহ ও মন সজীব ও সতেজ থাকে। এতে করে আমরা আল্লাহ তায়ালার রহমত, বরকত, ক্ষমা ও সর্বব্যাপী কল্যাণের সুশীতল ছায়ার আশ্রয়ে থাকি সারা দিনব্যাপী। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের (ফজরের ও আসরের সালাত) আগে সালাত আদায় করবে সে কখনো জাহান্নামে প্রবেশ করবে না’ (মুসলিম-৬৩৪)।
ফজরের সালাত আদায়ের সুফলগুলো হলো-
ক. স্রষ্টার সান্নিধ্যে দিনের শুরু : ফজরের সালাত মুমিনদের জন্য নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ সালাত। ফজর শব্দটি আরবি ‘ইনফজর’ শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ ‘তীব্রভাবে বিস্ফোরিত হওয়া’। যা সূর্যের আলোকে ইঙ্গিত করে। সূর্যের আলো যেমন রাতের অন্ধকার দূর করে পৃথিবীকে আলোকিত করে, পৃথিবীর প্রাণীদের জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্ভিদ জন্মাতে সাহায্য করে। একইভাবে, ফজরের সালাত মুমিনদের আলো ও দিকনির্দেশনা দেয় যার ফলে তাদের অন্তর আধ্যাত্মিক শক্তিতে আলোকিত হয়। আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দেয়ার মাধ্যমে তাই আমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে নিরাপত্তা লাভ করি, ‘যে ফজরের সালাত আদায় করল সে আল্লাহর পক্ষ থেকে জামানত লাভ করল। অতএব হে আদম সন্তান! লক্ষ্য রেখো আল্লাহ যেন অবশ্যই তোমাদের কাছে তার জামানতের কিছু দাবি না করেন’ (মুসলিম-৬৫৭)।
খ. সুন্নাহ পালন : ফজরের দুই রাকাত সুন্নাত সালাত আদায়ের মাধ্যমে আমরা নবী সা:-এর সুন্নাহ পালন করতে পারি। এই দুই রাকাতের মূল্য এত বেশি যে, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘ফজরের দুই রাকাত (সুন্নাত) পৃথিবী ও তাতে যা কিছু আছে সবার চেয়ে উত্তম’ (মুসলিম-২৫)।
মূলত সুন্নাহভিত্তিক লাইফস্টাইলেই আমাদের সর্বাধিক কল্যাণ নিহিত। নবী সা:-এর সুন্নাত হলো তাড়াতাড়ি ঘুমানো ও ভোরে ঘুম থেকে ওঠা। গবেষণায় দেখা গেছে, পর্যাপ্ত ঘুম এবং খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলে আমাদের বডি পর্যাপ্ত রিলাক্সের সময় পায়। যেসব মানুষ কম ঘুমায় তাদের এনার্জি লেভেল কম থাকে এবং ডিপ্রেশন ও উদ্বেগজনিত সমস্যায় ভোগে। যার ফলে তাদের মুড সুইং হয় এবং টেম্পার ট্র্যানট্রাম জনিত সমস্যায় ভোগে। অন্য দিকে গুডনাইট স্লিপ বডির প্রপার ফাংশনিংয়ে সাহায্য করে। যার ফলে বডিতে ব্লাড সাপ্লাই বৃদ্ধি পায়, হাড় ও টিস্যু রিপিয়ারিং ভালো হয়। ব্লাড প্রেসার কমায় এবং বডি রিলাক্সেশন হয়। ব্যায়াম করার পর্যাপ্ত সময় থাকায় বডি ফিটনেসও ভালো হয়। মেডিক্যাল এক্সপার্টদের মতে, লাইফস্টাইল জনিত রোগ, বিশেষ করে মহিলাদের ওবেসিটি, থাইরয়েড, পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমের (পিওএস) মতো সমস্যাগুলোর অন্যতম কারণ অপর্যাপ্ত ঘুম, উপযুক্ত খাবার ও ব্যায়ামের অভাব। কিন্তু যারা তাড়াতাড়ি ঘুমায় ও ভোরে ওঠে তাদের পর্যাপ্ত স্লিপ সাইকেল শরীরের অঙ্গসমূহের সঠিক কাজ করতে সাহায্য করে এবং হরমোন উৎপাদন স্বাভাবিক রাখে।
গ. ফেরেশতাদের উপস্থিতির সময় : আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সূর্য হেলে পড়ার পর থেকে রাতের ঘন অন্ধকার পর্যন্ত সালাত কায়েম করুন। আর ফজরের সালাত। নিশ্চয়ই ফজরের সালাত উপস্থিতির সময় (১৭ : ৭৮)।
হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, ফজরের সালাতের সময় দিবা-রাত্রির উভয়দল ফেরেশতা উপস্থিত থাকে এবং খুব মনোযোগের সাথে তিলাওয়াত শুনে। তাই ফজরের মর্যাদা আল্লাহর কাছে অনেক বেশি। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন , ‘তোমাদের কাছে দিন ও রাত্রির ফেরেশতা পালাক্রমে যাতায়াত করতে থাকে। আর ফজর ও আসরের নামাজে তারা একত্র হন। তারপর যারা তোমাদের কাছে রাত কাটিয়েছেন তারা ঊর্ধ্বাকাশে চলে যান। অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমরা আমার বান্দাদেরকে কী অবস্থায় ছেড়ে এসেছো? তারা বলেন, আমরা যখন তাদেরকে ছেড়ে এসেছি তখন তারা সালাতে প্রবৃত্ত ছিল। আর যখন আমরা তাদের কাছে গিয়েছিলাম তখনো তারা সালাতে ছিল’ (মুসলিম-৬৩২)।
ঘ. মুমিন ও মুনাফিকের পার্থক্য করে : পরিপূর্ণ মুমিনের পথ পরিক্রমা ত্যাগ-তিতিক্ষার। তাই আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দিতে মুমিন ভোরের আরামের ঘুম বিসর্জন দেয় অবলীলায়। কারণ সে জানে, ঘুম থেকে সালাত উত্তম। কিন্তু অপর দিকে, ‘মুনাফিকের ওপর ফজর ও এশার নামাজ অপেক্ষা অধিক ভারী সালাত আর নেই। যদি তারা এর ফজিলত ও গুরুত্ব জানত তাহলে হামাগুঁড়ি দিয়ে হলেও মসজিদে উপস্থিত হতো’ (মুসলিম-৬৫১)।
আর ফজরের সালাত জামাতের সাথে আদায়ের গুরুত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি জামাতের সাথে এশার সালাত আদায় করল সে যেন অর্ধরাত্রি ইবাদত করল আর যে ফজরের সালাত জামাতে আদায় করল সে যেন সারারাত সালাত পড়ল’ (মুসলিম-৬৫৬)।
ঙ. বরকতময় ফজর : ফজরের সময়টা সুন্দর এবং বরকতময়। তখন পৃথিবী নিশ্চুপ এবং স্থির থাকে। তাই ফজরের বারাকাহও চারপাশে অনুভূত হয়, যা আত্মিক স্বাস্থ্যের সুষমতা এবং প্রশান্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে। ফলে আমাদের প্রডাক্টিভিটিও সচল থাকে সারা দিন। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সা: আমাদের জন্য ভোরের সময়টাকে বরকতময় করার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন। তিনি তাঁর যুদ্ধ থেকে শুরু করে সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফজরের সময়ই করতেন। এ ছাড়াও সময়মতো সালাত আদায়ের মাধ্যমে আমরা সময়ানুবর্তিতার শিক্ষা পাই। সারা দিনের বাকি সালাতগুলোও একটা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে করার অনুপ্রেরণা পাই। এতে করে সারা দিনের সময়ের যথোপযুক্ত ব্যবস্থাপনা সহজ হয়। পর্যাপ্ত সময় পাওয়ায় ধীরে সুস্থে দিনের বাকি কাজ করা যায়। মন মেজাজ তাই থাকে পজিটিভ এনার্জিতে ভরপুর।
Ben Franklin-এর বিখ্যাত লাইন আমরা সবাই জানি, “Early to bed and early to rise, Makes a men healthy wealthy and wise.”
বাস্তবিকই যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার জন্য সকালের বিকল্প নেই। অধিকতর সফল মানুষরা জানে সকাল সার্থক তো জীবন সার্থক। আমাদের প্রিয় নবী সা: থেকে শুরু করে সফল সিইও ও রাজনীতিকদের সকালে ওঠা একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। কারণ তারা দার্শনিক Richard Whatley-এ কথাটি জানে যে, “Lose an hour in the morning and you will be all day haunting for it.”
টেক্সাস ইউনিভার্সিটিতে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব ছাত্রছাত্রী নিয়মিত সকালে উঠে তারা দেরিতে উঠা ছাত্রদের তুলনায় পরীক্ষায় ভালো স্কোর করে। সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোও ভোরে ওঠার উপকারিতা স্বীকার করেছে। তারা দেখেছে, যারা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে তাদের চরিত্রের সব ইতিবাচক পারসনালিটির বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।
চ. আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে : ফজরের সময়টা সর্বোত্তম সময় আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতা লাভের। সময় মতো সালাত আদায়ের মাধ্যমে নফসকে আমরা পরাজিত করি। সকালবেলার সূর্য যেমন সব অন্ধকার দূর করে দেয়, তেমনি ফজরের সালাত আদায় আমাদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে নফসের শিকল থেকে। এটি একটি বড় এবং পবিত্র যুদ্ধ নিজের বিবেকের ও নফসের। ফজরের সালাত আদায়ের মাধ্যমে আমরা নিজেদের অলসতা ও অসচেতনতা এবং অবসন্নতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করি। কারণ, ‘তোমাদের কেউ যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন শয়তান তার ঘাড়ের পেছনের অংশে তিনটি গিঁট দেয়। প্রতি গিঁটে সে এ বলে চাপড়ায়- তোমার সামনে রয়েছে দীর্ঘ রাত। অতএব তুমি শুয়ে থাকো। এরপর সে জাগ্রত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করলে একটি গিঁট খুলে যায়। পরে অজুু করলে আরেকটি গিঁট খুলে যায়। এরপর সালাত আদায় করলে বাকিটিও খুলে যায়। তখন তার সকাল হয় উৎফুল্ল মনে ও অনাবিল চিত্তে। অন্যথায় সে সকালে উঠে কলুষ কালিমা ও আলস্য নিয়ে’ (বুখারি-১১৪২)।
ছ. মেডিটেশন বা ধ্যানের উপযুক্ত সময় : ফজরের সালাতের সময়টা মেডিটেটিভ এক্সারসাইজের জন্য উৎকৃষ্ট সময়। চারপাশের প্রশান্ত পরিবেশ সালাতে খুশুখুজু বজায় রাখতে সাহায্য করে। যা আমাদের দেহ ও মনকে সারা দিন অধ্যাত্মিক শক্তিতে ভরিয়ে রাখে। মেডিটেশন বা ধ্যানের শারীরিক ও আত্মিক সুফল অনেক। কিন্তু মুসলিমরা সালাত আদায়ের মাধ্যমে মেডিটেশনের সর্বোচ্চ সুফল পেতে পারে। ইসলামিক মেডিটেশনকে ‘মোরাকাবা’ বলা হয়। আল্লাহর স্মরণে তখন শরীর ও মন একাত্ম হয়ে থাকে। হেদায়াত, শোকর আর রবের দাসত্বের মহিমায় হৃদয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। যার ফলে আত্মিক প্রশান্তিতে দেহ ও মন ভরে থাকে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে ভোরের নিরিবিলি সময় আমাদের শরীর ও মগজের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভোরের প্রশান্ত পরিবেশ আমাদের ব্রেইনে অক্সিজেন সরবরাহ বৃদ্ধি করে। ব্লাড প্রেসার কমায়। মাইগ্রেন সমস্যা দূর করে। ব্রেইনের কাজের গুণগত মান বাড়ার ফলে জটিল চিন্তা, সঙ্কটের সমাধান করার দক্ষতা এবং মনোযোগ ও স্মরণে রাখার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
ফিতনার এ যুগে সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে থাকা সহজ নয়। কিন্তু যারা নফসের সাথে যুদ্ধ করে প্রতিনিয়ত নিজের ঈমান ও আমলের হিফাজতের চেষ্টায় রত তাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে বেহিসাব পুরস্কার বরাদ্দ। তারা আল্লাহর নূরের আলোয় আলোকিত থাকে। তাই আঁধারের কালো তাদের ছুঁতে পারে না। মুমিনদের সঠিক পথে রাখার জন্যই পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের এই নির্দেশনা। যার মাধ্যমে তারা তাদের রবের কাছে নিজেকে সঁপে দেয় সালাতের প্রতি ওয়াক্তে। আর ফজরের সালাত আদায়ের মাধ্যমে দিনের শুরু মুমিনদের আত্মিক প্রশান্তিতে ভরিয়ে রাখে।
দিনের প্রথম সালাত ফজর আদায়ের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে বারাকাহ ও নূর লাভ করি যা ভোরের সময়টাতেই শুধু পাওয়া যায়। যা আমাদের বিবেকের উদাসীনতা ও অসচেতনতা থেকে রক্ষা করে। ফজরের সালাত মুমিনদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ একটি ব্যালান্স ও হেলদি লাইফস্টাইলে অভ্যস্ত হওয়ার। আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দেয়ার এই মহৎ সুযোগ মুমিনদের আধ্যাত্মিক পূর্ণতা লাভে সাহায্য করে। আল্লাহ আমাদের সালাত আদায়ের মাধ্যমে বারাকাহ লাভের তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখিকা : গবেষক
কোন মন্তব্য নেই