কারসাজির নতুন রুট ‘ব্লক মার্কেট - TIMES EXPRESS | টাইমস এক্সপ্রেস is an interactive news portal

নিউজ ফাস্ট

কারসাজির নতুন রুট ‘ব্লক মার্কেট





 

শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বাজারকে ভালো রাখার লক্ষ্যে কারসাজি চক্র নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আর কারসাজি চক্র নিয়ন্ত্রণ সংস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গলী দেখিয়ে বেপরোয়াভাবে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে। এবার নতুন কৌশল হিসাবে বেচে নিয়েছে ব্লক মার্কটকে। ব্লক মার্কেটে বিশাল বিশাল শেয়ারের লেনদেন দেখিয়ে বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্দ করছে।


জানা যায়, ব্লক মার্কেটে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সাধারণত অংশগ্রহণ করে না। বরং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ব্লকে বেশি লেনদেন করে। তবে কেউ চাইলে পাঁচ লাখ টাকার উপরের সমমানের শেয়ার ব্লক মার্কেটে লেনদেন করতে পারে। সেই প্রক্রিয়ায় কারসাজি চক্র নিজেরা নিজেরা বিভিন্ন কোম্পানির কোটি কোটি টাকার শেয়ার হাতবদল করছে আর এসব শেয়ার হাতবদল করছে কেবল সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ারগুলোতে আকৃষ্ট করার জন্য।


গত দুই সপ্তাহে বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কিছু নির্দিষ্ট কোম্পানির শেয়ার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনে বাজারে সাময়িক সংকট তৈরী করছে কারসাজি চক্রগুলো। এরপর কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর বাড়াতে শুরু করে নান কৌশল। আর শেয়ার দর বাড়িয়ে বেশি দামে তারা আবার সেসব শেয়ার বিক্রি করে চম্পট দিচ্ছে। এরই ফাঁকে শেয়ার দর বাড়তে দেখে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ওইসব শেয়ারে ঝুঁকছে। এক দিকে বেশি দামে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ারগুলো কিনছে, অন্যদিকে কারসাজি চক্র সেসব শেয়ার বিক্রি করে বেরিয়ে যাচ্ছে। এতে করে চড়া দরে শেয়ার কিনে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আটকে পড়ছে এবং সমূহ ক্ষতির মুখে পড়ছে।


বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারসাজি চক্রগুলো এখন বেচে নিয়েছে ব্লক মার্কেটকে। ব্লক মার্কেটে শেয়ার লেনদেন হয় মূলত ক্রেতা বিক্রেতার উভয়ের মধ্যে ডিলের (চুক্তির) মাধ্যমে। যেদিন রেগুলার মার্কেটে কোনো শেয়ারের দর ও লেনদেন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো হয়, সেদিন ব্লক মার্কেটেও বেশি দরে বিশাল শেয়ার লেনদেন করানো হয়। ব্লক মার্কেটে শেয়ারের বিশাল লেনদেন দেখিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ারটি কিনতে প্রলুব্দ করে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা চড়া দরে শেয়ারটি কিনতে ঝুঁকছেও। আর চড়া দরে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাঁধে শেয়ারটি চাপিয়ে তারা নিরাপদে সটকে পড়ছে।


গত সপ্তাহজুড়ে শেয়ারনিউজের পর্যবেক্ষণে ব্লক মার্কেটের মাধ্যমে কয়েকটি শেয়ার কারসাজির স্পষ্ট চিত্র ধরা পড়ে। কোম্পানিগুলোর অবস্থা নিচে তুলে ধরা হলো:




ডেল্টা লাইফ ইন্সুরেন্স:গত কয়েকদিন যাবত ডেল্টা লাইফের শেয়ার দর ঊর্ধ্বমুখী রযেছে। গত ৮ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটির শেয়ার দর ছিল ১৩৭ টাকা ৫০ পয়সায়। এর পর থেকে কোম্পানিটির শেয়ার দর বাড়তে থাকে। গত সপ্তাহে কোম্পানিটির দর ১৬৯ টাকা ৮০ পয়সায় তোলা হয়।

সেই সময়েও ব্লক মার্কেটে বিশাল বিশাল লেনদেন দেখা যায়। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল: ১২ সেপ্টেম্বর ২৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা, ১৪ সেপ্টেম্বর ২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা, ১৫ সেপ্টেম্বর ১৭ কোটি ২৫ লাখ টাকা।


আজ বুধবার (২২ সেপ্টেম্বর) ডেল্টা লাইফের শেয়ার দর উঠেছে ১৭১ টাকায়। এটি কোম্পানিটির গত দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ দর। আজ রেগুলার বা স্বাভাবিক মার্কেটে কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হয় ৩৪ লাখ ৭৪ হাজার ৯২৭টি শেয়ার। যার বাজার মূল্য ৫৯ কোটি ১৩ হাজার টাকার কিছু বেশি। কোম্পানিটি আজ ডিএসইতে লেনদেন তালিকায় ৫ম নম্বরে ছিল। রেগুলার মার্কেটে শেয়ারটি লেনদেন হয়েছে ১৫৮ টাকা ৬০ পয়সা থেকে ১৭৪ টাকা ৪০ পয়সা পর্যন্ত।


অন্যদিকে, আজ ব্লক মার্কেটে কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৪৭ লাখ ৮০ হাজার শেয়ার। যার বাজার মূল্য ৮০ কোটি ৫১ লাখ টাকা। ব্লক মার্কেটে শেয়ারটি লেনদেন হয়েছে ১৬৭ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১৭২ টাকা পর্যন্ত। এর আগে গত সপ্তাহে কোম্পানিটির ব্লক মার্কেটে লেনদেন হয়েছে ৪৮ কোটি ৬৬ লাখ ১৮ হাজার টাকার।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্লক মার্কেটে কোম্পানিটির বিশাল শেয়ার লেনদেন করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মনোযোগ আকৃষ্ট করার অপপ্রয়াস চালানো হয়েছে। শেয়ারটিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্দ করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নানা রকম প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়।


ন্যাশনাল হাইজিং ফাইন্যান্স:গত কয়েকদিন যাবত ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্সের শেয়ার দর ঊর্ধ্বমুখী ছিল। গত ৮ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটির শেয়ার দর ছিল ৬২ টাকা ২০ পয়সা। এর পর থেকে কোম্পানিটির শেয়ার বাড়তে থাকে। গত সপ্তাহে কোম্পানিটির দর ৯০ টাকা ৫০ পয়সায় তোলা হয়। যা গত দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সেই সময়েও ব্লক মার্কেটে বিশাল বিশাল লেনদেন দেখা যায়। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল: ১২ সেপ্টেম্বর ১২ কোটি ৪১ লাখ টাকা, ১৬ সেপ্টেম্বর ৯ কোটি ৫৩ লাখ টাকা, ১৯ সেপ্টেম্বর ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা, ২০ সেপ্টেম্বর ৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।


আজ বুধবার (২২ সেপ্টেম্বর) ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্সের শেয়ার দর উঠেছে ৮২ টাকা ৮০ পয়সায়। আজ রেগুলার মার্কেটে কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১০ লাখ ৪২ হাজার ৬৩৩টি শেয়ার। যার বাজার মূল্য ৮ কোটি ৭৪ হাজার টাকার কিছু বেশি। আজ শেয়ারটি লেনদেন হয়েছে ৮২ টাকা ৮০ পয়সা। আজ ব্লক মার্কেটে লেনদেন হয়েছে ৯৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা।


এনভয় টেক্সটাইল:চলতি সপ্তাহে এনভয় টেক্সটাইলের শেয়ার দর ঊর্ধ্বমুখী হয়। গত ২ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটির শেয়ার দর ছিল ৩৪ টাকা ৭০ পয়সা। এর পর থেকে শেয়ার বাড়তে থাকে। গত সপ্তাহে কোম্পানিটির দর ৪৪ টাকা ৪১ পয়সায় তোলা হয়। সেই সময়েও ব্লক মার্কেটে কোম্পানিটির বিশাল বিশাল লেনদেন দেখা যায়। চলতি সপ্তাহে কোম্পানিটির শেয়ার বিক্রির প্রক্রিয়ায় থাকে। এ সময়ে ব্লক মার্কেটে বিশাল লেনদেন দেখানো হয়। এরমধ্যে ১৯ সেপ্টেম্বর লেনদেন হয় ১৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা এবং আজ ২২ সেপ্টেম্বর ৪৩ কোটি ২০ লাখ টাকার লেনদেন দেখানো হয়।


আজ বুধবার (২২ সেপ্টেম্বর) এনভয় টেক্সটাইলের শেয়ার দর উঠেছে ৪৩ টাকা ৫০ পয়সায়। আগের দিন কোম্পানিটির গত দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ দরে শেয়ার লেনদেন হয়েছে। আজ রেগুলার মার্কেটে কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১ লাখ ৯১ হাজার ৯৫০টি শেয়ার। যার বাজার মূল্য ৮৩ লাখ ৬০ হাজার টাকার কিছু বেশি। রেগুলার মার্কেটে শেয়ারটি লেনদেন হয়েছে ৪৩ টাকা ৮০ পয়সা।


অন্যদিকে, আজ ব্লক মার্কেটে কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১ কোটি ৮০ লাখ। যার বাজার মূল্য ৪৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা।




জেনেক্স ইনফোসিস:গত কয়েকদিন যাবত এনভয় টেক্সটাইল শেয়ার দর ঊর্ধ্বমুখী রযেছে। গত 2 সেপ্টেম্বর কোম্পানিটির শেয়ার দর ছিল ৩৪ টাকা ৭০ পয়সা। এর পর থেকে কোম্পানিটির শেয়ার বাড়তে থাকে। গত সপ্তাহে কোম্পানিটির দর ৪৪ টাকা ৪১ পয়সায় তোলা হয়। সেই সময়েও ব্লক মার্কেটে কোম্পানিটির বিশাল বিশাল লেনদেন দেখা যায়। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল: ১২ সেপ্টেম্বর ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা, ১৪ সেপ্টেম্বর ৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা, ১৫ সেপ্টেম্বর ২২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, ২১ সেপ্টেম্বর ৮৬ লাখ টাকা।


আজ বুধবার (২২ সেপ্টেম্বর) জেনেক্স ইনফোসিসের শেয়ার দর উঠেছে ১১৬ টাকা ৬০ পয়সায়। আজ রেগুলার মার্কেটে কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১৩ লাখ ১৭ হাজার ১৪৮টি শেয়ার।



যার বাজার মূল্য ১৫ কোটি ৪৫ হাজার টাকার কিছু বেশি। রেগুলার মার্কেটে শেয়ারটি লেনদেন হয়েছে ১১৬ টাকা ৬০ পয়সায়।


আজ ব্লক মার্কেটে কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১ লাখ শেয়ার। যার বাজার মূল্য ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। ব্লক মার্কেটে শেয়ারটি লেনদেন হয়েছে ১২০ টাকায়। গত সপ্তাহে কোম্পানিটি ব্লক মার্কেটে লেনদেন হয়েছে ৩৫ কোটি ২৮ লাখ ৫০ হাজার টাকার।


উল্লে্খ্য, কিছুদিন আগে জেনেক্স ইনফোসিসের শেয়ার দর হঠাৎ করে দ্বিগুনের বেশি তোলা হয়। তখন দুই দফায় কোম্পানিটির বড় বড় মূল্য সংবেদনশীল তথ্যও প্রচার করা হয়। কিন্তু এতে বিনিয়োগকারীদের মনোযোগ আকৃষ্ট করা যায়নি। সেজন্য বিকল্প কৌশল হিসাবে ব্লক মার্কেটকে বেচে নেওয়া হয়েছে বলে বাজার সংশ্লিষ্টরা আঙ্গুল তুলছেন।


বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় প্রতিদিনই কিছু কিছু কোম্পানির বিশাল বিশাল শেয়ার লেনদেন দেখানো হয়। এসব কোম্পানির শেয়ার চিহ্নিত কয়েকজন ব্যক্তির বিও হিসাব থেকে করা হয় বা চিহ্নিত কয়েটি ভুইফোঁড় প্রতিষ্ঠানের নামে দেখানো হয়। এসব লেনদেনের বেশিরভাগই একই প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা হয়, আবার বিক্রিও হয়। এতে সুবিধা হল-একই প্রতিষ্ঠান থেকে একইদিন লেনদেন হলে ডিএসইকে টাকা দিতে হয় না। কেনা-বেচার হিসাব অ্যাডজাস্ট হয়ে যায়।


বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারা ব্লক মার্কেটে প্রতিদিন কিছু কিছু কোম্পানির বিশাল বিশলাল লেনদেন করছে? কোন কোন প্রতিষ্ঠান করছে? কারা সেসব প্রতিষ্ঠানের মালিক? কেন ব্লক মার্কেটে বিশাল বিশাল লেনদেন করছে? কী উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে? যদি সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তাদের দিয়ে সুষ্ঠু তদন্ত করানো হয়, তাহলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে। যারা শেয়ারবজারের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে চায়, তাদের চেহারা উম্মোচন হবে। বাজার সংশ্লিষ্টরা ও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এসব কারসাজি চক্রের কুট-কৌশলের সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দোষিদের শাস্তির আওতায় আনার জোর দাবি জানিয়েছে।



কোন মন্তব্য নেই