করোনাকালে এক-চতুর্থাংশ কর্মী এনআরবি ব্যাংক ছেড়েছে - TIMES EXPRESS | টাইমস এক্সপ্রেস is an interactive news portal

নিউজ ফাস্ট

করোনাকালে এক-চতুর্থাংশ কর্মী এনআরবি ব্যাংক ছেড়েছে








 


পরিচালকদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জেরে বছর খানেক আগে চাকরি হারিয়েছিলেন এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেহমুদ হোসেন। তার পর থেকে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনায় অস্থিরতা বেড়েছে। শুধু ২০২০ সালেই ব্যাংকটিতে চাকরি হারিয়েছেন ৮৯ জন কর্মকর্তা। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ৬৬ জন কর্মকর্তা চাকরি হারিয়েছেন। চাপ দিয়ে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা, চাকরিচ্যুতি বা ছুটিতে পাঠানোর মতো শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে এসব কর্মীকে ব্যাংক ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।


২০১৩ সালে কার্যক্রম শুরু করা এনআরবি ব্যাংকের বর্তমান কর্মীর সংখ্যা ৬৪৩। এর মধ্যে শুধু করোনাকালেই ১৫৫ জন কর্মী এনআরবি ব্যাংক ছেড়েছেন। অন্য ব্যাংক থেকে এনে বা নতুন নিয়োগ দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে ব্যাংকটি। এনআরবি ব্যাংক সূত্র বলছে, শুধু চলতি বছরেই ৩১ জন কর্মকর্তাকে চাপ দিয়ে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। প্রায় দুই বছর ধরে চলতে থাকা এ অস্থিরতা সাম্প্রতিক সময়ে আরো বেড়েছে। ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ১১টি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান কর্মকর্তাকে চাকরি খুঁজতে বলা হয়েছে। এছাড়া চাকরি খুঁজতে বলা হয়েছে এনআরবি ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ অন্তত ১৮টি শাখার ব্যবস্থাপককেও। সকাল-বিকাল চাকরি হারানোর ঘটনায় চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকটির কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ ও অস্থিরতা বাড়ছে। ব্যাংক কর্মীদের চাকরি সুরক্ষায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া নীতিমালাও এনআরবি ব্যাংকে অনুসরণ করা হচ্ছে না বলে জানা গেছে।


সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত অভিযোগ না থাকলে ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ছাঁটাই করা যাবে না বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা রয়েছে। তার পরও গত দুই বছরে হাজার হাজার কর্মীকে কৌশলে ছাঁটাই বা চাকরি ছাড়তে বাধ্য করেছে ব্যাংকগুলো। এ অবস্থায় কর্মদক্ষতা মূল্যায়নের নামে করোনাকালে যেসব কর্মীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, তাদের ব্যাংকে ফেরানোর নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত কোনো অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও চাকরিচ্যুত হয়েছেন কিংবা চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের (আবেদনপ্রাপ্তি সাপেক্ষে) বিধি অনুযায়ী চাকরিতে বহাল করতে হবে। গত সপ্তাহে এ নির্দেশনা জারি হওয়ার পর এনআরবি ব্যাংকের দুজন কর্মকর্তা চাকরি ফেরত পাওয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছেন। আরো কয়েক ডজন কর্মকর্তা চাকরি ফেরত পাওয়ার জন্য আবেদন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।


তবে এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন মাহমুদ শাহ বলছেন, কোনো কর্মীকেই চাপ দিয়ে কিংবা অন্য কোনো পন্থা অবলম্বন করে এনআরবি ব্যাংক ছাড়তে বাধ্য করা হয়নি। গত দুই বছরে যারা এনআরবি ব্যাংক ছেড়েছেন, তাদের প্রত্যেকেই অপেক্ষাকৃত ভালো চাকরি পেয়ে ব্যাংক ছেড়েছেন। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনআরবি ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং চাকরিচ্যুতরা ভিন্ন কথাই বলছেন।


সম্প্রতি এনআরবি ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান ইমতিয়াজ আহমেদকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। অপ্রত্যাশিতভাবে চাকরি হারানো এ ব্যাংকার বর্তমানে বেকার। বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে ব্যাংকটির কোম্পানি সেক্রেটারি হাসানুল হককে। চাকরি হারিয়েছেন ব্যাংকটির ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স (আইসিসি) বিভাগের প্রধান বাদল কুমার নাথ।


মাত্র তিন মাস আগে শরিয়াহভিত্তিক একটি ব্যাংক থেকে এনআরবি ব্যাংকে এসেছেন আবুল কাশেম মো. ছফিউল্লাহ। তিনি ব্যাংকটির ইসলামিক ব্যাংকিং ইউনিটের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। তাকেও নতুন চাকরি খুঁজতে বলা হয়েছে। এ নিয়ে হতাশায় আছেন এ ব্যাংক কর্মকর্তা।


সম্প্রতি পুঁজিবাজারে শেয়ার কেনাবেচায় কারসাজির ঘটনায় এনআরবি ব্যাংকের সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ঘটনায় ব্যাংকটিকে ৪৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। পাশাপাশি শেয়ার কারসাজিতে জড়িত কর্মীদের খুঁজে বের করে শাস্তি নিশ্চিত করার জন্যও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে শেয়ার কারসাজির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ব্যাংকের প্রধান হিসাব কর্মকর্তা (সিএফও) কামরুল হাসানকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। যদিও ব্যাংকটির গুরুত্বপূর্ণ একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, ব্যাংকের যেকোনো বিনিয়োগের জন্য অন্তত তিনটি কমিটির অনুমোদন নিতে হয়। যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সিএফও চাকরিচ্যুত হয়েছেন, সেটির সঙ্গে এনআরবি ব্যাংকের পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের নেতৃস্থানীয় অনেকেই জড়িত। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করার কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেয়া হয়নি।


প্রাপ্ত তথ্য বলছে, চলমান মহামারীতে ব্যাংকটির বনানী শাখার ব্যবস্থাপক সাইফুদ্দিন সরকার, উত্তরা শাখার ব্যবস্থাপক আকতার হোসেন, ধানমন্ডি শাখার ব্যবস্থাপক এবিএম মোরশেদ, চকবাজার শাখার ব্যবস্থাপক নুর এ আলম খন্দকার চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। একই সময়ে ব্যাংকের এফএভিপি এনএম শফিউল আজম খান, এসভিপি তারেকুজ্জামান, এসপিও তারেক আনোয়ার বিন রশিদ, রইস উদ্দিন, সায়েমা কামাল, কাজী আহনাফ সাকিবসহ দেড় শতাধিক কর্মকর্তা পদত্যাগের চাপ কিংবা বিভিন্ন কারণে এনআরবি ব্যাংক ছেড়েছেন।


করোনার কারণে গত বছর বন্ধ ছিল এনআরবি ব্যাংক কর্মীদের পদোন্নতি। তবে সম্প্রতি ১৬৬ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছে ব্যাংকটি। যদিও এ পদোন্নতি নিয়েও বড় ধরনের আপত্তি উঠেছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকের পদোন্নতি নীতিমালা লঙ্ঘনেরও ঘটনা ঘটেছে। এমন ১৪ জন কর্মকর্তার পদোন্নতি হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে ব্যাংকের পক্ষ থেকেই বিভাগীয় তদন্ত ও শাস্তি চলছে। পদোন্নতির ক্ষেত্রে যোগ্যরা উপেক্ষিত হয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। এ অবস্থায় পুরো পদোন্নতি প্রক্রিয়া নিয়েই ব্যাংকের পক্ষ থেকে নিরীক্ষা চালানো হচ্ছে।


২০১২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক একসঙ্গে যে নয়টি ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়, তার একটি হলো এনআরবি ব্যাংক। একই সময়ে কার্যক্রম শুরু করা অন্য অনেক ব্যাংকের তুলনায় বেশ পিছিয়ে পড়েছে ব্যাংকটি। ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে এনআরবি ব্যাংকে গ্রাহকদের আমানতের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ১৮৩ কোটি টাকা। একই সময়ে ৩ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছিল ব্যাংকটি। সব মিলিয়ে বিদায়ী বছর শেষে এনআরবি ব্যাংকের সম্পদ ও দায়ের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা। যদিও চতুর্থ প্রজন্মের অনেক ব্যাংকের সম্পদ ও দায়ের পরিমাণ অনেক আগেই ১৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।


পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির চাপে থাকা ব্যাংকটির মুনাফা পরিস্থিতিও সন্তোষজনক নয়। সর্বশেষ ২০২০ সালের জন্য ৮ দশমিক ৫ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড (বোনাস শেয়ার) ঘোষণা করেছে ব্যাংকটি। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির আবেদন করার জন্য যা কাঙ্ক্ষিত মাত্রার নয়। ২০১৯ সালে ১২ কোটি টাকা নিট লোকসান দেয়া এনআরবি ব্যাংক ২০২০ সালে ৬৭ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছে। মূলত করোনাকালে দেয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিসহায়তার সুযোগেই ব্যাংকটি এ মুনাফা করতে পেরেছে।


সামগ্রিক বিষয়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন মাহমুদ শাহ বণিক বার্তাকে বলেন, কর্মকর্তাদের চাকরি ছাড়ার জন্য চাপ দেয়ার কোনো ঘটনা আমার জানা নেই। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে মাত্র একজন ছাড়া কোনো কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়নি। অনেকেই ভালো চাকরি পেয়ে এনআরবি ব্যাংক থেকে চলে গিয়েছেন। ভালো কর্মীকে ব্যাংকে রাখার জন্য আমরা নিজেরাই চেষ্টা ও অনুরোধ করি।


এনআরবি ব্যাংক থেকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হওয়া গুরুত্বপূর্ণ অনেক কর্মকর্তা এখনো বেকার। ভালো চাকরি পেয়ে কেউ পদত্যাগ করলে তারা বেকার কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে মামুন মাহমুদ শাহ বলেন, চাকরি ছেড়ে দেয়ার পর কেউ বেকার থাকলে সেটি দেখার দায়িত্ব আমার নয়।


ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য ও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির বিষয়ে মামুন মাহমুদ শাহ বলেন, পুঁজিবাজারে আইপিও নিয়ে আসার জন্য আমরা ইস্যু ম্যানেজার নিয়োগ দিয়েছি। ব্যাংকের আর্থিক সূচকগুলোর উন্নতি করার জন্য চেষ্টা করছি। কাঙ্ক্ষিত মানে ডিভিডেন্ড দিতে না পারলে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়াটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।




কোন মন্তব্য নেই