বিশ্বব্যাপী উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলাই বড় চ্যালেঞ্জ - TIMES EXPRESS | টাইমস এক্সপ্রেস is an interactive news portal

নিউজ ফাস্ট

বিশ্বব্যাপী উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলাই বড় চ্যালেঞ্জ

 


করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাপী মার্কিন ডলারের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ফলে অনেক দেশ ডলারের বিপরীতে তাদের স্থানীয় মুদ্রার মান কমাতে বাধ্য হয়। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া চলমান থাকায় জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন আবশ্যিক উন্নয়ন উপকরণের মূল্যও অস্বাভাবিক গতিতে বাড়তে শুরু করে।


একই সময়ে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’র মতো শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ প্রায় প্রতিটি পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি ১৩০ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়। পরে রাশিয়া কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করায় আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বমুখী মূল্য কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসে। কিন্তু এ যুদ্ধ সহসাই বন্ধ না হলে বিশ্ব অর্থনীতিতে এর প্রভাব আরও ব্যাপকভাবে পড়বে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন।


মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ঊর্ধ্বমুখী থাকার অর্থ হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাওয়া। এ অসহনীয় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে প্রয়োজনীয় পণ্যগুলো স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের মাধ্যমে ভোক্তা চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করা। কিন্তু সব দেশ চাইলেই তাদের ভোক্তাদের চাহিদা স্থানীয়ভাবে পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে মেটাতে পারবে না। যেমন, মধ্যপ্রাচ্যের একটি মরুময় দেশ চাইলেই অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি করে তাদের খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। তাদের যে কোনো মূল্যে বাইরে থেকে খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে থাকার কারণে তাদের পক্ষে হয়তো বাইরে থেকে উচ্চমূল্যে খাদ্যপণ্য আমদানি করা অসম্ভব নয়। কিন্তু অন্যসব দেশ চাইলেই তাদের খাদ্যপণ্য উচ্চমূল্যে আমদানির মাধ্যমে মেটাতে পারবে না। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ্ব একটি ‘গ্লোবাল ভিলেজে’ পরিণত হয়েছে। কোনো দেশই এখন আর বিচ্ছিন্নভাবে টিকে থাকতে পারছে না। কাজেই আন্তর্জাতিক অর্থনীতি এবং রাজনীতির গতি-প্রকৃতির প্রতি সবসময়ই দৃষ্টি রাখতে হয়। আন্তর্জাতিক অর্থনীতির প্রতি দৃষ্টি রাখতে গেলেই আমাদের ডলারের মূল্যের ওঠানামার প্রতি লক্ষ রাখতে হয়। বিশ্বব্যাপী ডলারের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু জোগান সেভাবে বাড়ছে না। ফলে সর্বত্রই এক ধরনের ক্রাইসিস লক্ষ করা যাচ্ছে।


আন্তর্জাতিক মুদ্রা বলে বিশ্বে কোনো একক মুদ্রা নেই। কিন্তু মার্কিন ডলার তার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার কারণে অনেকটাই আন্তর্জাতিক মুদ্রার রূপ পরিগ্রহ করেছে। বিশ্বের মোট বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ৬২ শতাংশই মার্কিন ডলারে সংরক্ষণ করা হয়। ২০০০ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একক মুদ্রা ইউরো প্রচলিত হওয়ার সময় প্রত্যাশা করা হয়েছিল, কয়েক বছরের মধ্যে বিশ্ব রিজার্ভের অন্তত ১৫ শতাংশ ইউরোতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু তা হয়নি। অনেক দেশেই ডলারের তুলনায় ইউরোর বিনিময় হার বেশি। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটা কোনোভাবেই বলা যাবে না যে ডলারের অবস্থান ইউরোর কাছে হুমকির মুখে পড়েছে।


আর কোনো দেশের মুদ্রা ডলারের মতো এতটা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের যে অবনতি হয়েছে, তা মার্কিন ডলারের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার ৮ শতাংশ অতিক্রম করে গেছে। বিগত ৪০ বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি আর কখনোই এতটা ঊর্ধ্বমুখী হয়নি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে ভোক্তাদের ক্রয় করার প্রবণতা কিটা হলেও হ্রাস পেয়েছে। আর বিভিন্ন দেশ থেকে উদ্বৃত্ত অর্থ যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করছে। ফলে ডলারের অবস্থান আরও দৃঢ় হয়েছে।


বিশ্ব অর্থনীতিতে এখন সবচেয়ে আলোচিত প্রসঙ্গ হচ্ছে তীব্র মূল্যস্ফীতি। অনেক দেশের অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। বেশিরভাগ দেশই তাদের নিজস্ব মুদ্রার ব্যাপক অবমূল্যায়ন ঘটিয়েছে। দ্য ইউএস ডলার ইনডেক্স মোতাবেক, গত ২০ বছরের মধ্যে মার্কিন ডলার এখন সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণেই ডলারের বিনিময় হার বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলো সুদের হার বাড়ানোর ফলে দেশটির উদ্বৃত্ত অর্থের মালিকরা বাইরে বিনিয়োগের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। উপরন্তু অন্যান্য দেশের উদ্বৃত্ত অর্থের মালিকরা তাদের অর্থ কোনো না কোনোভাবে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৎপর হয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় ভারত থেকে মার্কিন বিনিয়োগ উঠে যাচ্ছে। এশিয়াসহ প্রতিটি দেশের স্থানীয় মুদ্রা ব্যাপক দরপতনের শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, ২০২১ সালের মে মাস থেকে ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের স্থানীয় মুদ্রা টাকার দরপতন হয়েছে ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ভারতীয় মুদ্রার দরপতন হয়েছে ৬ দশমিক ১১ শতাংশ। পাকিস্তানি রুপির দরপতন হয়েছে ২০ দশমিক ৭৪ শতাংশ। জাপানি ইয়েনের দরপতন হয়েছে ১৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ। অন্যান্য দেশের মুদ্রার মধ্যে ভিয়েতনামি মুদ্রা ডং শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ, ব্রিটিশ পাউন্ড ১২ দশমিক ২৪ শতাংশ, ইউরো ১৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ, নেপালি রুপি ৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ, চীনা মুদ্রা ৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ, মিসরীয় মুদ্রা ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকার মুদ্রা ১৫ দশমিক ৬১ শতাংশ, অস্ট্রেলীয় ডলার ৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।

মার্কিন ডলার বিশ্ব অর্থনীতিকে নানাভাবে প্রভাবিত করে থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্ব বাণিজ্যে বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণ বেড়েছে। বিশ্ব বাণিজ্যের ৯০ শতাংশই সম্পাদিত হয় মার্কিন ডলারে। বিশ্বে প্রতিবছর যে ঋণ প্রদান করা হয় তার ৪০ শতাংশই গৃহীত হয় ডলারে। বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ যে ঋণ প্রদান করে তা মার্কিন ডলারেই প্রদান করে। প্রতিটি দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে মার্কিন ডলার থাকতেই হয়। নন-আমেরিকান ব্যাংকগুলো দায়-দেনার দুই-তৃতীয়াংশই মেটানো হয় ডলারে। ২০২১ সালে বিশ্বের মোট রিজার্ভের মধ্যে ৭ দশমিক ৮৭ ট্রিলিয়ন সংরক্ষিত হয় মার্কিন ডলারে। আর ইউরোতে রিজার্ভ সংরক্ষণের পরিমাণ হচ্ছে মাত্র ৩৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। রাশিয়া ও চীন নানাভাবে চেষ্টা করেছিল তাদের স্থানীয় মুদ্রায় রিজার্ভ সংরক্ষণের। কিন্তু তারা এতে সফল হয়নি।


এখন প্রশ্ন হলো, ডলারের বাজারে এমন অস্থিতিশীলতার কী প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে? বর্তমানে কোনো দেশই বিশ্ব অর্থনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। কাজেই বিশ্ববাজারে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশের আমদানি ব্যয় সাংঘাতিকভাবে বেড়ে গেছে। গত অর্থবছরের পুরো সময়ে বাংলাদেশ ৬ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল। এ বছর নয় মাসেই ৬ হাজার ১৫২ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। রপ্তানি বেড়েছে, কিন্তু তা আমদানির মতো এতটা বাড়েনি। বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে আড়াই হাজার কোটি ডলার। গত অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ। এ বছর প্রথম ৯ মাসে এ ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কয়েকবার স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটিয়েছে।


বাংলাদেশ ব্যাংক ১৯৯৩ সাল থেকে মুদ্রাবাজারে ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট চালু করে। ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট চালু করার ফলে মুদ্রা বাজারে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ করার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলাদেশ ব্যাংক পরোক্ষভাবে মুদ্রা বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে। ডলারের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু ডলার বাজারে বিক্রি করে দেয়। এতে ডলারের জোগান বৃদ্ধি পায়। ফলে ডলারের ঊর্ধ্বমুখী মূল্যপ্রবণতা কিছুটা হলেও রোধ হয়। আবার বাজারে কোনো সময় ডলারের জোগান বেড়ে গেলে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে কিছু ডলার কিনে নেয়। এতে বাজার স্থিতিশীল থাকে। কিন্তু এবার সে ধরনের কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কারণ ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পেতে শুরু করেছে। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২৭২ কোটি ডলার। পরবর্তী বছর তা ৩ হাজার ৬০৪ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৬৩৯ কোটি ডলার। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে রিজার্ভ কমে ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারে নেমে আসে। অবশ্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতে, বাংলাদেশের প্রকৃত রিজার্ভের পরিমাণ প্রদর্শিত রিজার্ভের চেয়ে অন্তত ৭০০ কোটি ডলার কম। এখানে অবশ্য একটি বিষয় স্মরণ রাখতে হবে, ডলারের স্ফীত রিজার্ভ সবসময় অর্থনীতির জন্য ভালো লক্ষণ নাও হতে পারে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ব্যক্তি খাতে উচ্চমাত্রায় বিনিয়োগ এবং স্ফীত রিজার্ভ একটি দেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে ভালো অবস্থানের নির্দেশক। এমনকি তুলনামূলক স্বল্প রিজার্ভ এবং উচ্চমাত্রায় বিনিয়োগও কাঙ্ক্ষিত হতে পারে। কিন্তু বিনিয়োগবিহীন স্ফীত রিজার্ভ কোনোভাবেই কাম্য নয়। কারণ এটা অর্থনীতির স্থবিরতার লক্ষণ।

কোন মন্তব্য নেই