কারিগরির সনদ জালিয়াতি নজরদারিতে আরও অনেকে - TIMES EXPRESS | টাইমস এক্সপ্রেস is an interactive news portal

নিউজ ফাস্ট

কারিগরির সনদ জালিয়াতি নজরদারিতে আরও অনেকে

 

বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সনদ জালিয়াতির ঘটনায় থলের বিড়ালের সন্ধান পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। মূলহোতা বোর্ডের কম্পিউটার সেলের সিস্টেম এনালিস্ট একেএম শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তারের পর একে একে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য বেরিয়ে আসছে। ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে এখন পর্যন্ত ৩০ জনের নাম বেরিয়ে এসেছে। এদের মধ্যে এখন পর্যন্ত বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রীসহ মোট ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার বোর্ড চেয়ারম্যান আলী আকবর খানকে তলব করা হয়েছে ডিবিতে।


তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সনদ জালিয়াতির ঘটনায় বোর্ডের পরিচালক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ, শিক্ষক, সাংবাদিক, দুদক কর্মকর্তাসহ অনেকের নাম পাওয়া গেছে। তাদের বিষয়ে তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করে তাদের তালিকা তৈরির কাজ করছে ডিবি। এ ঘটনায় কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আরও ৩ কর্মকর্তার না পাওয়া গেছে। তারা হলেন-  কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সিবিএ নেতা আব্দুল বাছের, রেজিস্ট্রেশন শাখার এসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রামার মামুনুর রশীদ ও বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জাকারিয়া আব্বাস। তারা বিভিন্ন সময় বোর্ডের কম্পিউটার সেলের সিস্টেম এনালিস্ট একেএম শামসুজ্জামানকে শিক্ষার্থীদের রেজাল্ট পরিবর্তন ও জাল সার্টিফিকেট তৈরি করার কথা বলতেন।



তাদের দাবি অনুযায়ী শামসুজ্জামান সার্টিফিকেট তৈরি করে দিতেন এবং রেজাল্ট পরিবর্তন করে দিতেন। তবে এই জন্য তারা শামসুজ্জামানকে কোনো টাকা দিতেন না। একই বোর্ডের লোক হওয়ায় শামসুজ্জামান তাদের কাছে টাকা চাইতে সাহস পেতো না। এই ৩ জন ছাড়া বোর্ডের আরও অনেক কর্মকর্তা এই সার্টিফিকেট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। তাদের নাম জানার চেষ্টা করছে ডিবি। 

তদন্ত কর্মকর্তারা বলেন, সার্টিফিকেট জালিয়াতিতে দুদক কর্মকর্তার নাম উঠে এসেছে। শামসুজ্জামানের সার্টিফিকেট দুর্নীতি সংক্রান্ত একটি মামলা হয় দুদকে। দুদকের উপ-পরিচালক পদ মর্যাদার এক কর্মকর্তা মামলার তদন্তের জন্য শামসুজ্জামানকে ডাকেন। এরপর থেকে দুদকের ওই কর্মকর্তাকে বিভিন্নভানে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন শামসুজ্জামান।  কিন্তু সেই কর্মকর্তাকে ম্যানেজ না করতে পেরে দুদকের উপ-পরিচালক পদ মর্যাদার আরেক কর্মকর্তার দ্বারস্থ হন শামসুজ্জামান। সেই কর্মকর্তা শামসুজ্জামানকে তার বাড্ডার বাসায় ডেকে নেন। ওই কর্মকর্তা শামসুজ্জামানকে বলেন, এখন যে কর্মকর্তার কাছে মামলার তদন্ত আছে তাকে ম্যানেজ করা যাবে না। তাই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করতে হবে, এই জন্য দুদকের এই কর্মকর্তাকে ৩০ লাখ দিতে হবে শামসুজ্জামানকে। শামসুজ্জামান ওই কর্মকর্তার দাবি অনুযায়ী ৩০ লাখ টাকার ডলার কিনে তাকে দেয়। টাকা দেয়ার পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে। নতুন তদন্ত কর্মকর্তাও দুদকের উপ-পরিচালক পদ মর্যাদার আরেকজন কর্মকর্তা। তিনি প্রায় ১০ লাখ টাকার ওপরে টাকা শামসুজ্জামানের কাছ থেকে নিয়ে তাকে দুদকের মামলা থেকে অব্যাহতি দেন।


রিমান্ডে ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে শামসুজ্জামান সাটিফিকেট জালিয়াতির আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন। তিনি ডিবিকে বলেন, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সার্টিফিকেট কাগজ প্রতি বান্ডেলে ৫০০টি করে থাকে। বান্ডেলে করা এসব কাগজ তিনি শিক্ষা বোর্ডের অফিস থেকে সংগ্রহ করতেন। তবে তার কাছে জাল সার্টিফিকেট তৈরির এত চাহিদা থাকতো বোর্ডের কাগজ দিয়ে সামাল দিতে পারতেন না। তাই  কাগজের যোগান ঠিক রাখতে রাজধানীর পুরান ঢাকা ও রংপুরের একটি প্রেসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাদেরকে কাগজের নমুনা দেখানোর পর তারা হুবহু সার্টিফিকেটের কাগজ তৈরি করে দিতেন শামসুজ্জামানকে। শামসুজ্জামান প্রতিদিন অফিস শেষ করে বাসায় গিয়ে এসব কাগজ দিয়ে জাল সার্টিফিকেট তৈরি করতেন। এসব জাল সার্টিফিকেটের প্রিন্ট করার কাজ করতো তার ব্যক্তিগত সহকারী ফয়সাল। রাজধানীর পীরেরবাগ এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নেয়া হয়েছিল সার্টিফিকেট প্রিন্ট করার জন্য।


শামসুজ্জামান ডিবিকে জানান, ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তিনি এই জাল সার্টিফিকেট তৈরি করা শিখেন। মোহাম্মদ শামসুল আলম নামে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সিস্টেম এনালিস্টের কাছ থেকে এই জালিয়াতি শিখেছেন শামসুজ্জামান। শামসুল আলম বিভিন্ন সময় ডিপ্লোমা পরীক্ষার সার্টিফিকেট জালিয়াতি করতেন। শামসুল আলমও শিক্ষার্থীদের কাছে জাল সার্টিফিকেট বিক্রি করতেন। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষায় যেসব শিক্ষার্থীরা পাস করতে পারতো না তাদের নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে পাস করিয়ে দিতেন শামসুল। শামসুলের কাছ থেকে শিখে শামসুজ্জামান এসএসসি ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং এর পরীক্ষার্থীদের জাল সার্টিফিকেট বানানোসহ পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর বাড়িয়ে দিতেন। ডিবি জানিয়েছে, শিক্ষার্থীরা প্রথমে সার্টিফিকেটের জন্য দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করতো। পরে দালালরা শামসুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করতো। পরে শামসুজ্জামান জাল সার্টিফিকেট তৈরি করতেন। প্রতিটি সার্টিফিকেট ৩০ হাজার থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিতেন শামসুজ্জামান। এ ছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালকরাও যোগাযোগ করতো তার সঙ্গে। পরিচালকরা সার্টিফিকেট প্রতি ৩০-৫০ হাজার টাকা দিলেও তারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আরও মোটা অংকের টাকা নিতো। প্রায় ৩০ জনের মতো দালাল ও পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে শামসুজ্জামানের। 


ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর-রশীদ বলেছেন, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে রোববার ওএসডি করা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি অফিসে ডাকা হয়েছে। সনদ জালিয়াতিতে তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। এ ছাড়া এ ঘটনায় যাদের নাম এসেছে পর্যায়ক্রমে সবাইকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। মূলহোতা শামসুজ্জামানের জবানবন্দিতে দুদক কর্মকর্তা ও যেসব সাংবাদিকের নাম উঠে এসেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুলিশ, সাংবাদিক, দুদক সবাইকে তো মানুষ ভয় পায়। আমরা যদি কারও পক্ষে থাকি, সেই মানুষগুলো সাহসী হয়। সিস্টেম অ্যানালিস্ট ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে যা যা বলেছেন, তা আপনারা অনেকেই শুনেছেন। যাদের নাম এসেছে, পর্যায়ক্রমে ডাকবো। সকলের সঙ্গে কথা বলে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে মামলাটি শেষ করবো।


মিরপুর মডেল থানায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তাররা হলেন- কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কম্পিউটার সেলের সিস্টেম এনালিস্ট জালিয়াতির মূলহোত একেএম শামসুজ্জামান, তার ব্যক্তিগত সহকারী ফয়সাল, কুষ্টিয়া গড়াই সার্ভে ইনস্টিটিউটের পরিচালক সানজিদা আক্তার কলি, কামরাঙ্গীরচর হিলফুল ফুযুল টেকনিক্যাল এন্ড বিএম কলেজের অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান ও ঢাকা টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের পরিচালক মো. মাকসুদুর রহমান ওরফে মামুন এবং বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী সেহেলা পারভীনকে। ডিবি লালবাগ বিভাগ তাদেরকে গ্রেপ্তার করেছে। সেহেলা পারভীনকে গত শনিবার গ্রেপ্তার করা হয়। রোববার তাকে দুইদিনের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন মঞ্জুর করেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত। 

কোন মন্তব্য নেই