কারাগারের আদালতে বিচারকের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বার বার আসতে পারব না, যত খুশি সাজা দিন - TIMES EXPRESS | টাইমস এক্সপ্রেস is an interactive news portal

নিউজ ফাস্ট

কারাগারের আদালতে বিচারকের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বার বার আসতে পারব না, যত খুশি সাজা দিন



নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কারাগারের ভেতরে বিশেষ জজ আদালতের অস্থায়ী এজলাস বসিয়ে জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুনীির্তর মামলা বিচারের ব্যবস্থা করায় অসন্তোষ জানিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, এ আদালত চলতে পারে না।

বুধবার বেলা সোয়া ১২টার দিকে নতুন এই এজলাসে বিচার কাযর্ক্রম শুরুর পর খালেদা জিয়া নিজের অসুস্থতার কথা তুলে ধরে বিচারককে বলেন, ‘আপনার যতদিন ইচ্ছা সাজা দিন, আমি এ অবস্থায় বারবার আসতে পারব না। এ আদালতে ন্যায়বিচারও হবে না।’

খালেদা জিয়াসহ এ মামলার তিন আসামিকে এজলাসে হাজির করা হলেও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা কেউ না আসায় বিচারের শেষ পযাের্য় থাকা এ মামলার শুনানি এদিন শুরু করা যায়নি।

আধা ঘণ্টারও কম সময় আদালতের কাযর্ক্রম চলার পর ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ মো. আখতারুজ্জামান ১২ ও ১৩ সেপ্টেম্বর শুনানির নতুন তারিখ ঠিক করে দেন। যুক্তিতকের্র শুনানি শেষ হলেই সোয়া তিন কোটি টাকা আত্মসাতের এ মামলা রায়ের পযাের্য় যাবে।

আদালতে পুরোটা সময় খালেদা জিয়া ছিলেন হুইল চেয়ারে বসা। তার পরনে ছিল ট্রেডমাকর্ গোলাপি শাড়ি, পায়ে সাদা জুতা। 

চেয়ারে বসা অবস্থায় তার পায়ের উপরের অংশ থেকে নিচ পযর্ন্ত সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা ছিল।

জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুনীির্তর মামলার শুনানি এতদিন চলছিল কারাগারের কয়েকশ’ গজ দূরে বকশীবাজারে আলিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন কারা অধিদপ্তরের মাঠে বিশেষ এজলাসে।

নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে মঙ্গলবার আইন মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রশাসনিক ভবনের ৭ নম্বর কক্ষকে ‘আদালত’ ঘোষণা করে সেখানেই দাতব্য ট্রাস্ট দুনীির্তর মামলার শুনানি করার নিদের্শ দেয়।

এ কারাগারেই আরেকটি ভবনের দোতলার একটি কক্ষে গত সাত মাস ধরে বন্দি রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। এতিমখানা দুনীির্তর মামলায় গত ৮ ফেব্রæয়ারি একই বিচারক তাকে ৫ বছর কারাদÐ দেন।

এতিমখানা দুনীির্ত মামলার রায়ের পর খালেদা জিয়াকে এক দিনও দাতব্য ট্রাস্ট মামলার শুনানিতে হাজির করা হয়নি। প্রায় প্রতি তারিখেই আদালতকে তার অসুস্থতার কথা জানানো হয়েছে কারাগারের পক্ষ থেকে। ফলে এ মামলায় যুক্তিতকের্র শুনানি আটকে রয়েছে সাত মাস ধরে।

দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বলে আসছিলেন, খালেদা জিয়া ‘অসুস্থতার ভান করছেন’। এ অবস্থায় সরকার কারাগারের ভেতরেই আদালত বসিয়ে বিচার এগিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে মঙ্গলবার বিকালে প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন মন্ত্রণালয়।

সেখানে বলা হয়, বকশীবাজার এলাকার সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা ও সাবেক ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সংলগ্ন মাঠে নিমির্ত এলাকাটি জনাকীণর্ থাকে। সেজন্য নিরাপত্তাজনিত কারণে বিশেষ জজ আদালত-৫ নাজিমউদ্দিন রোডের পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রশাসনিক ভবনের ৭ নম্বর কক্ষকে আদালত হিসেবে ঘোষণা করা হলো।

‘বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন বিশেষ মামলা নং ১৮/২০১৭ এর বিচার কাযর্ক্রম পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রশাসনিক ভবনের কক্ষ নং ৭ এর অস্থায়ী আদালতে অনুষ্ঠিত হইবে।’

খালেদা জিয়ার দল বিএনপি কারাগারে আদালত বসানোর এই সিদ্ধান্তকে ‘সংবিধান পরিপন্থি’ আখ্যায়িত করে তার মুক্তির দাবিতে মানবন্ধন ও প্রতীক অনশনের কমর্সূচি দিয়েছে।

যেমন ছিল আদালত

কারাগারের মূল ফটক দিয়ে ঢুকে প্রশাসনিক ভবনের নিচতলায় ডান দিকে ৭ নম্বর কক্ষে সাজানো হয়েছে এ অস্থায়ী আদালতের এজলাস। সেখানে ঢোকার পথে ডান পাশের একটি কক্ষকে বানানো হয়েছে বিচারকের খাস কামরা।

সকালে আদালত কক্ষে গিয়ে দেখা যায় এজলাস লাল কাপড়ে মুড়ে বিচার কাজের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। বিচারকের চেয়ারের বঁা পাশে তৈরি করা হয়েছে আসামির কাঠগড়া, তার সামনে সাদা কাপড়ে মোড়া টি-টেবিল আর একটি চেয়ার।

উল্টো দিকে সাক্ষীর কাঠগড়া। আর সামনে প্রসিকিউশনের বসার ব্যবস্থা। আসামিপক্ষের উকিলদের বসার জায়গা হয়েছে বিচারকের মুখোমুখি। আর এজলাসের সামনে পেশকারের বসার জায়গা।

বেলা সোয়া ১১টার দিকে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক মো. আখতারুজ্জামান খাস কামরায় যান। এর পরপরই দুই পুলিশ সদস্য মামলার নথিপত্রে একটি ট্রাঙ্ক পৌঁছে দেন।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা সকাল ১০টার দিকেই আদালতকক্ষে হাজির হন। দুদকের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল, আবদুল্লাহ আবু, শাহআলম তালুকদারকে আদালতে তাদের নিধাির্রত জায়গায় বসে থাকতে দেখা যায়।

আসামিপক্ষের আইনজীবীরা না এলেও ঢাকা বারের সভাপতি বিএনপিপন্থি আইনজীবী গোলাম মোস্তফা খান আদালতকক্ষে উপস্থিত ছিলেন। তার ভাষ্য, পযের্বক্ষক হিসেবে তিনি আদালতে এসেছেন।

এ মামলার আসামি জিয়াউল ইসলাম মুন্না ও মনিরুল ইসলাম খানকে আদালতের কাযর্ক্রম শুরুর আগেই আসামির কাঠগড়ায় হাজির করা হয়। সোয়া ১২টার দিকে কারাকক্ষ থেকে প্রধান আসামি খালেদা জিয়াকে নিয়ে আসা হয় আদালত কক্ষে।

আসামিদের কাঠগড়ার সামনে যেখানে খালেদা জিয়া হুইল চেয়ারে বসে ছিলেন, তার পাশেই টি-টেবিলে ছিল টিসু আর পানি। তাকে কয়েকবার টিসুতে মুখ মুছতে দেখা যায়।

খালেদা জিয়াকে আদালত কক্ষে হাজির করার পরপরই বিচারক মামলার কাযর্ক্রম শুরু করেন। 

যা হলো আদালতে

আদালতের কাযর্ক্রম শুরু হলে প্রথমে বক্তব্য দেন দুদকের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল। মামলার সবের্শষ পরিস্থিতি এবং নতুন করে আদালতের স্থান নিধার্রণের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন তিনি।

কাজল আদালতকে জানান, এ মামলায় প্রসিকিউশনের যুক্তিতকর্ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। মামলার দুই আসামি জিয়াউল ইসলাম মুন্না ও মনিরুল ইসলাম খানের পক্ষে যুক্তিতকর্ উপস্থাপনের মধ্যেই প্রায় ৯ মাস ধরে শুনানি বন্ধ রয়েছে।

‘এ অবস্থায় পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের এ স্থানে অস্থায়ী আদালত ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। আসামি খালেদা জিয়ার আইনজীবীর কাছে প্রজ্ঞাপনের কপি পাঠানো হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবেও তাদের ফোন করে জানিয়েছি।

‘এছাড়া মিডিয়ার মাধ্যমে সকলকে অবহিত করা হয়েছে। তবে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা এখন আদালতে উপস্থিত নেই।’

কাজল এই অবস্থাতেই বিচার কাযর্ক্রম শুরু করতে আদালতের কাছে আজির্ জানান এবং মুন্না ও মনিরুলের কাছে জানতে চান তাদের আইনজীবীরা কোথায়।

এরপর বিচারক বলেন, যেহেতু তারিখ নিধাির্রত ছিল, আইনজীবীরা উপস্থিত হননি। তাদের উপস্থিত হওয়ার জন্য কোটর্ এক ঘণ্টা মূলতবি করা হচ্ছে।

ঢাকা বারের সভাপতি ও বিএনপিপন্থি আইনজীবী গোলাম মোস্তফা খান এ সময় দঁাড়িয়ে বলেন, প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে রাতে। খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা কেউ আদালত স্থানান্তরের বিষয়ে অবহিত নন। এ কারণে তারা সবাই বকশীবাজারের আদালতে গেছেন।

‘আমি একজন অবজারভার হিসেবে এখানে এসেছি। আর আমাদের সবার ফোন বাইরে রেখে দেয়া হয়েছে। এখান থেকে যোগাযোগ করাও সম্ভব নয়। একজন অবজারভার হিসেবে আমার মনে হয় তারিখ পেছানোই যৌক্তিক হবে।’

আদালতের পরিস্থিতিও ‘বিচার কাযর্ক্রম শুরুর মতো নয়’ মন্তব্য করে গোলাম মোস্তফা বলেন, ৫০ ফুট বাই ২০ ফুটের এই ছোট জায়গার অবস্থাও তেমন ভালো নয়। আইনজীবীসহ সবার বসার জায়গা সেভাবে নেই। পরবতীের্ত সুবিধাজনক সময়ে ও জায়গায় বিচার কাযর্ক্রম চালানো হোক।

বিচারক আখতারুজ্জামান তখন বলেন, ‘প্রজ্ঞাপনতো কালকে জারি হয়েছে। আর মামলার ডেটতো আগেই ছিল। তারিখ পেছাতে হলেও তো আইনজীবীদের পিটিশন লাগবে।’

এ সময় কোনো আসামির আইনজীবী উপস্থিত না থাকায় এবং ‘যোগাযোগ সম্ভব না’ বলে শুনানির নতুন তারিখ নিধার্রণের কথা বলেন ঢাকা বারের সভাপতি।

তখন খালেদা জিয়া আদালতের উদ্দেশে বলেন, ‘আমার আইনজীবীদের কেউ তো এখানে নেই। আমার শারীরিক অবস্থাও ভালো নয়। ডাক্তার বলেছে, এভাবে বসে থেকে বেশিক্ষণ পা ঝুলিয়ে রাখলে ফুলে যেতে পারে। হাতেও প্রচÐ ব্যথা। এ অবস্থায় আদালত চলতে পারে না।’

বিচারকের উদ্দেশে সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ অবস্থায় তার পক্ষে বারবার আদালতে আসা সম্ভব নয়, বিচারক যতদিন ইচ্ছা সাজা দিয়ে দিতে পারেন।

খালেদা বলেন, ‘সাজাইতো হবে, ন্যায়বিচার নাই এখানে।’

এরপর আইনজীবী গোলাম মোস্তফা এবং কাজলের কিছু বক্তব্য শোনেন বিচারক। পরে ১২ ও ১৩ সেপ্টেম্বর মামলার শুনানির তারিখ নিধার্রণ করে তিন আসামির জামিন বাড়ানোর জন্য আবেদন জমা দিতে বলেন তিনি।

বেলা ১২টা ৪০ মিনিটে আদালত কক্ষ থেকে বেরিয়ে কারা কক্ষে ফেরার সময় সাংবাদিকদের সামনেও কথা বলেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

তিনি বলেন, ‘এখানে আদালত হওয়ার সিদ্ধান্ত হলো সাতদিন আগে, গেজেট জারি কালকে করা হলো কেন? আদালত বসল, আমার সিনিয়র আইনজীবীরা জানে না। তাহলে আদালত চলে কীভাবে?’

নিজের শারীরিক অবস্থা ভালো নয় জানিয়ে ৭৩ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদ বলেন, ‘আমার বঁা পা ঠিকমতো রাখতে পারি না, প্যারালাইজড হয়ে যাওয়ার মতো। বঁা হাতেও অনেক ব্যথা।’

আদালতের ভেতরে নতুন এজলাসে এই শুনানিকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই আশপাশের এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। কারাগারের সামনের সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। বন্ধ রাখা হয় আশপাশের দোকানপাট।

বকশিবাজার, নাজিমুদ্দিন রোডের মাক্কুশা মাজারের কাছে, চকবাজার মোড়ে, বেগমবাজার মোড়ে ও আবুল হাসনাত রোডে দেখা যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া পাহারা। বিভিন্ন স্থানে পথচারীদের তল্লাশি করা হয়। কারাগারের কাছে প্রস্তুত রাখা হয় ফায়ার সাভিের্সর গাড়ি।

মামলা বৃত্তান্ত

জিয়া দাতব্য ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগে খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে ২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগঁাও থানায় মামলাটি করেছিল দুদক।

২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি মামলার তদন্ত কমর্কতার্ দুদকের উপপরিচালক হারুন-অর-রশীদ আদালতে অভিযোগপত্র দেন। ২০১৪ সালের ১৯ মাচর্ অভিযোগ গঠনের পর শুরু হয় বিচার।

মামলার অন্য আসামিরা হলেন খালেদার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী এবং হারিছের তৎকালীন একান্ত সচিব (বতর্মানে বিআইডবিøউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক) জিয়াউল ইসলাম মুন্না, ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।

দীঘির্দনেও বিচার শেষ না হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ নেতারা খালেদার আইনজীবীদের সময়ক্ষেপণকে দায়ী করে আসছেন। অন্যদিকে বিএনপি নেতাদের দাবি, আওয়ামী লীগ সরকারের ইন্ধনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে এই মামলাটি করা হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই