বিধিনিষেধের মধ্যে খোলা অনেক শিল্প-কারখানা
সিরামিক খাতের একটি কারখানাকেও গতকাল বিধিনিষেধ ভঙ্গের অভিযোগে শাস্তি পেতে হয়েছে। গাজীপুরে প্যারাগন সিরামিকস লিমিটেড নামের ওই কারখানাটির কর্মী সংখ্যা ১ হাজার ৪৫০। অবৈধভাবে খোলা ও পরিচালনার দায়ে কারখানাটিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। বন্ধ করা হয় কারখানার কার্যক্রম।
পোশাক ও সিরামিক খাতের ছাড়াও গতকাল দেশের শিল্প অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় প্রায় ৩০০ কারখানা খোলা ছিল। এসব এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি তদারকির দায়িত্বে থাকা শিল্প পুলিশের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এর মধ্যে বিধিনিষেধের আওতাভুক্ত কারখানা রয়েছে ৬৭টি।
ঈদের ছুটির পর ২৩ জুলাই ভোর ৬টা থেকে ৫ আগস্ট মধ্যরাত পর্যন্ত সার্বিক কার্যাবলি ও চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ১৯ জুলাই এক নির্দেশনায় বিধিনিষেধের আওতাবহির্ভূত কার্যক্রম সম্পর্কে জানানো হয়। নির্দেশনা অনুযায়ী বিধিনিষেধের আওতাবহির্ভূত কার্যক্রমের মধ্যে ছিল খাদ্য ও খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন-প্রক্রিয়াকরণ মিল-কারখানা, কোরবানির পশুর চামড়া পরিবহন, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ এবং ওষুধ, অক্সিজেন ও কভিড-১৯ প্রতিরোধে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদনকারী শিল্প। সরকারের এ ঘোষণার সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিধিনিষেধের আওতাভুক্ত বেশ কয়েকটি খাতের কারখানাও খোলা রাখা হচ্ছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ও শিল্প পুলিশের প্রধান মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, সরকারের বিধিনিষেধ যেন শিল্প এলাকাগুলোতে কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে আমাদের তদারকি চলছে। এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, গতকাল বিধিনিষেধের আওতাভুক্ত থাকলেও প্যাকেজিং ও কার্টন কারখানা খোলা ছিল নয়টি। যার মধ্যে একটি কারখানা আশুলিয়া-সাভার এলাকার। এছাড়া গাজীপুরের পাঁচটি, নারায়ণগঞ্জের দুটি ও ময়মনসিংহের দুটি কারখানা খোলা ছিল। সিরামিক কারখানা খোলা ছিল মোট পাঁচটি। এর মধ্যে আশুলিয়া-সাভারে একটি, গাজীপুরে তিনটি ও খুলনায় একটি কারখানা খোলা ছিল। শিল্প এলাকাগুলোতে প্লাস্টিক কারখানা খোলা ছিল দুটি। রি-রোলিং মিল খোলা ছিল দুটি। অ্যাকসেসরিজ কারখানা খোলা ছিল চারটি। এছাড়া খোলা ছিল সিমেন্ট, প্রসাধনী প্রস্তুত ও ফোম তৈরির কারখানা।
আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও খুলনা—এ ছয় এলাকা শ্রমঘন বলে বিবেচিত। এলাকাগুলোয় বস্ত্র, তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, আসবাব, সেলফোন সংযোজন, ওষুধ ও অন্যান্য খাতের মোট কারখানার সংখ্যা ৭ হাজার ৮২৪। ঈদুল আজহার ছুটির আগে শেষ কর্মদিবস ১৯ জুলাই রাত ১০টা পর্যন্ত ৭ হাজার ৪৭৩ কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়।
এর আগে গত শনি ও রোববার বিধিনিষেধের প্রথম দুই দিনেও সরকারের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে কিছু কারখানা চালু রাখার চেষ্টা চলছিল। বিধিনিষেধের প্রথম দুই দিনে গাজীপুরের তিনটি পোশাক কারখানা ও একটি প্লাস্টিক কারখানায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেছেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। একই সঙ্গে কারখানাটির উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
শনিবার ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয় গাজীপুর মহানগরীর কাশিমপুর সারাবো এলাকায় নরবান কমটেক্স লিমিটেড নামে একটি পোশাক কারখানা চালু রাখার কারণে। একই দিন টঙ্গীর টিঅ্যান্ডটি বাজার এলাকায় আনোয়ার গ্রুপের এ ওয়ান পলিমার লিমিটেড নামের প্লাস্টিক পণ্য তৈরির কারখানাটি খোলা রেখে উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগে কর্তৃপক্ষকে ৭০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এ সময় কারখানার শ্রমিকদের বের করে এটি বন্ধ করে দেয়া হয়।
রোববার কাশিমপুরের নয়াপাড়া এলাকার কটন ক্লাব বিডি লিমিটেডের ডায়িং সেকশনে ১৫০ জন শ্রমিক দিয়ে কার্যক্রম চালু রাখার দায়ে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। পরে কারখানার সব কার্যক্রম বন্ধ করে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ দেয়া হয়।
এ বিষয়ে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এসএম তরিকুল ইসলাম জানান, সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসন কঠোর অবস্থানে রয়েছে। কেউ যাতে এ নির্দেশনা অমান্য করে কারখানা কার্যক্রম চালু না রাখে, সেজন্য প্রতিদিনই আমরা জেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করছি এবং এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।
এদিকে, ঈদের পর বিধিনিষেধ আরোপ করে প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকেই কারখানা খোলা রাখার দাবি জানিয়ে আসছিলেন শিল্প মালিকরা। এ প্রস্তাব জানিয়ে সরকারের কাছে লিখিতভাবেও আহ্বান জানান সংশ্লিষ্ট শিল্প মালিক প্রতিনিধিরা। সরকার শিল্প মালিকদের দাবি আমলে না নিয়ে কভিড-১৯ সংক্রমণ রোধের আরোপিত বিধিনিষেধ কার্যকর করে ২৩ জুলাই ভোর থেকে। কিন্তু এখনো বিকল্প ব্যবস্থায় হলেও কারখানা খোলা রাখার তত্পরতা অব্যাহত রেখেছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের অর্থনীতি উজ্জীবিত রাখার স্বার্থে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কারখানা খোলা রাখার বিষয়ে এখনো আগ্রহী তারা।
জানতে চাইলে পোশাক শিল্প মালিকদের নিট পণ্য প্রস্তুতসংশ্লিষ্ট সংগঠন বিকেএমইএ প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, কারখানা খোলা বা বন্ধ রাখার বিষয়টি সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী চলমান আছে। সংগঠনের সদস্যদেরও সরকারের নির্দেশনা অনুসরণের আহ্বান জানানো হয়েছে। নিজস্ব কম্পাউন্ডের মধ্যে আবাসন ব্যবস্থায় যাদের শ্রমিক আছে, তারা কারখানা খোলা রাখার আবেদনটি বিবেচনা করার অনুরোধ জানিয়েছেন। এ বিষয়গুলো নিয়ে সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছি। ক্ষেত্রবিশেষে সরকারের প্রতিনিধিরাও আমাদের সঙ্গে একমত পোষণ করছেন। তারাও বলছেন কারখানা কম্পাউন্ডের ভেতরে থাকা শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো গেলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।মাঠপর্যায়ে সরকার এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিলে কিছু জরুরি উৎপাদন সচল রাখা সম্ভব হবে বলে জানান মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, দেশে বেশকিছু বস্ত্র খাতের কারখানা আছে যেগুলোয় শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা আছে। লোকসংখ্যা খুব কম এমন কারখানার মধ্যে আছে নিটিং-ডায়িং। এ ধরনের কারখানাগুলো চালু থাকলে বিধিনিষেধ শেষে বিদেশী মুদ্রা অর্জনকারী পোশাক খাতের পণ্য রফতানির কাঁচামালের জোগান সময়মতো সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে। এতে রফতানির পথ মসৃণ রাখা সম্ভব হবে।
এদিকে বিধিনিষেধের আওতার মধ্যে থাকায় কারখানা বন্ধ হলে যে ক্ষতি হবে তা কাটিয়ে ওঠার বিষয়েও তত্পর হয়েছে শিল্প মালিক প্রতিনিধি সংগঠন বিকেএমইএ। কারখানা বন্ধ রাখার ফলে রফতানি পরিকল্পনায় ব্যাঘাত ঘটলেও ভবিষ্যতে সুন্দরভাবে করোনামুক্ত পরিবেশে ব্যবসা পরিচালনার জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে সংগঠনের সদস্যদের আহ্বান জানিয়েছেন বিকেএমইএ সভাপতি সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান। ২৪ জুলাই সংগঠনের সদস্যদের উদ্দেশে দেয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে তিনি বলেছেন, আমরা আশা করছি চলতি লকডাউন শেষ হলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পুনরায় সহযোগিতার আবেদন জানাব। বিগত সময়ে প্রধানমন্ত্রী আমাদের জন্য যেভাবে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছিলেন, তেমনিভাবে তিনি আগামীতেও আমাদের জন্য এগিয়ে আসবেন বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।
কোন মন্তব্য নেই