রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা ক্ষতির শঙ্কা বাংলাদেশেও - TIMES EXPRESS | টাইমস এক্সপ্রেস is an interactive news portal

নিউজ ফাস্ট

রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা ক্ষতির শঙ্কা বাংলাদেশেও

 

রাশিয়ার বিরুদ্ধে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো। দেশটির বড় কয়েকটি ব্যাংকের সঙ্গে আন্তর্জাতিক অর্থ লেনদেন ব্যবস্থা সুইফটের কার্যক্রম বন্ধ হতে পারে। এ বিষয়ে মত দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো। এটি কার্যকর হলে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়বে রাশিয়া। এর ফলে রাশিয়ার সঙ্গে আমদানি-রপ্তানিসহ আর্থিক লেনদেনে সমস্যায় পড়তে পারে বাংলাদেশও। কারণ, বাংলাদেশ রাশিয়ার সঙ্গে আর্থিক লেনদেন সুইফটের মাধ্যমেই করে থাকে। রাশিয়ায় সুইফট বন্ধ হলে বাংলাদেশের কোনো ব্যাংক রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আর্থিক লেনদেন করতে পারবে না। আবার রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর পেমেন্ট বাংলাদেশ নিতে পারবে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশে নিয়মিত বিভিন্ন পণ্য আমদানি হচ্ছে। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের মধ্যে গমের চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। ভুট্টার ২০ শতাংশ আসে এই দু’টি দেশ থেকে। অন্যদিকে তৈরি পোশাক রপ্তানির নতুন বাজার হিসেবেও বিবেচনা করা হচ্ছে রাশিয়াকে। এ অবস্থায় সুইফট বন্ধ হলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ার পাশাপাশি বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে বাংলাদেশ। এ ছাড়া দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কাজ করছে রাশিয়া। এই কেন্দ্রে এক লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হবে। প্রকল্পের বিভিন্ন কাঁচামালও আসছে রাশিয়া থেকে। রাশিয়ায় আর্থিক ঝুঁকি তৈরি হলে এই প্রকল্পও সমস্যায় পড়তে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন বা সুইফট হলো আন্তর্জাতিক লেনদেনের প্রধান ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সহজভাবে পরিচালনায় ব্যাংকগুলো দ্রুত এবং নিরাপদে বৈশ্বিক লেনদেন করে থাকে। বাংলাদেশের সঙ্গেও রাশিয়ার আর্থিক লেনদেনের প্রধান মাধ্যম সুইফট। ফলে সুইফট রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর সঙ্গে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করলে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিশেষ করে আমদানিতে বড় সমস্যায় পড়বে বাংলাদেশ।

ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা মানবজমিনকে জানান, রাশিয়ার সঙ্গে আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে যে আর্থিক লেনদেন হয় সেটি সুইফটের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। অর্থাৎ বৈদেশিক বাণিজ্যের পেমেন্ট সুইফট ছাড়া বিকল্প কোনো মাধ্যম আপাতত নেই। বড় বড় লেনদেনগুলো সুইফট হয়েই আসে।

ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর মানবজমিনকে বলেন, এটি কার্যকর হলে বাংলাদেশ আর রাশিয়ার সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি করতে পারবে না। এলসি খুলতে পারবে না। এই মুহূর্তে বিকল্প কোনো মাধ্যমও নেই। তবে সব ব্যাংকের সঙ্গে সুইফট বন্ধ হচ্ছে না। যেগুলোতে হচ্ছে সেগুলো সব বড় বড় ব্যাংক। এখন আমাদের কোন ব্যাংকগুলোর সঙ্গে লেনদেন হয় সেটার ওপর ডিপেন্ড করবে। যদি হয়েই যায় তবে পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের বিষয়টি অবগত করবে। তখন কীভাবে লেনদেন করতে হবে সেটাও আমাদেরকে বলা হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা তো এখনো জানি না- কোন কোন ব্যাংক এর আওতায় পড়বে যাদের সঙ্গে আমরা লেনদেন করতে পারবো না। যেসব ব্যাংকের আওতায় পড়বে না, সেইসব ব্যাংকের সঙ্গে আমরা লেনদেন করতে পারবো। তবে দেখতে হবে সেইসব ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের অ্যাকাউন্ট আছে কিনা। না থাকলে নতুন করে করাটাও কঠিন হবে।

রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশে নিয়মিত আমদানি হচ্ছে তুলা, গম, ভুট্টা, সরিষা, মসুর ডাল। দেশে বছরে গমের চাহিদা সর্বোচ্চ ৭০ লাখ টনের মধ্যে ৩৫ লাখ টন আসছে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। ফলে সুইফট বন্ধ হলে রাশিয়া থেকে এসব আমদানি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। এতে দেশের বাজারে এসব পণ্যের সংকট দেখা দেয়ায় দামও বেড়ে যাবে। যার প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর। যদিও ইতিমধ্যেই উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সঙ্গে বাংলাদেশে পণ্য আমদানি কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। মূল্য বৃদ্ধি এবং পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় উভয় দেশের ব্যবসায়ীরা এটি করতে বাধ্য হয়েছেন।

বন্ধ রাখা হয়েছে পণ্যের এলসি ও শিপমেন্টও। এ অবস্থায় রাশিয়ার ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সুইফট বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশের বাণিজ্যে চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে। একইসঙ্গে বড় আর্থিক ক্ষতির মুখেও পড়তে পারে- এমনটিই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশের প্রথম রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ এর মতো বড় প্রকল্পের কাজ চলছে রাশিয়ার সহায়তায়। পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি ইউরেনিয়ামও আসবে দেশটি থেকে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজটিতেও যুক্ত থাকবে রাশিয়া। পাশাপাশি রাশিয়া থেকে বাংলাদেশ সামরিক সরঞ্জাম ও খাদ্যপণ্য আমদানি করে। এর বাইরে তৈরি পোশাক শিল্পের নতুন বাজার রাশিয়া।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে থেকে রাশিয়ায় রপ্তানি হয়েছে ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলারের পণ্য, যার মধ্যে তৈরি পোশাক সবচেয়ে বেশি। আমদানি হয়েছে ৪৬ কোটি ৬৭ লাখ ডলারের পণ্য, যার বেশির ভাগটাই খাদ্য পণ্য।

ওদিকে বাংলাদেশের মেগা প্রকল্পের মধ্যে একটি হচ্ছে রূপপুর নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র, যেখানে রাশিয়ান কোম্পানি রোসাটোম কাজ করছে। ওই কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে বাংলাদেশ সমস্যায় পড়বে বলে মনে করেন অনেকেই।

সবমিলিয়ে গোটা বিষয়টি নিয়েই বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি করেছে চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, যুদ্ধে রাশিয়ার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় নির্মাণাধীন পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পটির অগ্রগতিতে তাৎক্ষণিকভাবে নেতিবাচক কোনো প্রভাবের আশঙ্কা নেই। তার পরও চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতি বিবেচনায় পরিস্থিতি নিয়ে সতর্ক পর্যবেক্ষণ চালাচ্ছে সরকার।

দেশের ব্যবসায়ীরা জানান, ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের প্রভাব এরমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে তাদের ব্যবসার ওপর। যুদ্ধের কারণে পণ্যবাহী জাহাজগুলো এখন কৃষ্ণসাগরে যেতে চাইছে না। ফলে রপ্তানিকারকরাও চিন্তার মধ্যে পড়েছেন।

বিজিএমইএ’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, আমাদের বেশির ভাগ পণ্য আসে জাহাজের মাধ্যমে। সুইফটের মাধ্যমে লেনদেনে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলে এলসি’র মাধ্যমে দেশে টাকা কীভাবে আসবে সেটা নিয়েই চিন্তা। এ ঝামেলা থেকে মুক্ত হতে খুবই সতর্ক হতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দ্রুত সমাধান না হলে এই সংকটের বড় প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপরেও। বিশেষ করে জ্বালানি ও খাদ্য পণ্যের দাম বাড়লে তার প্রভাব সব ক্ষেত্রেই পড়ে। আর এটা শুধু বাংলাদেশ নয়,  সারা বিশ্বের জন্যই চিন্তার বিষয়। জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়েছে। এটা যানবাহন, কৃষি- সবকিছুর ওপর প্রভাব পড়ে।

সিপিডি’র বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো যদি বলে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞায় অন্য দেশগুলোও দেশটির সঙ্গে লেনদেন করতে পারবে না, তাহলে সেটা হবে মারাত্মক বিষয়। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য বড় কোনো সমস্য দেখা যাচ্ছে না। তবে ইতিমধ্যেই তেলের দাম বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ চাপে আছে।


বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান গম আমদানিকারক সিটি গ্রুপের একজন পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকে প্রতিবছর আট থেকে দশ লাখ টন গম আমদানি হয়। সেটা বাধাগ্রস্ত হবে।

এদিকে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের গত শনিবার রাতে বলেন, রোসাটোমের ওপর এখনো নিষেধাজ্ঞা হয়নি। রোসাটোমের ওপর যদি নিষেধাজ্ঞা আসে তবে দুশ্চিন্তার বিষয় হবে। তিনি বলেন, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার সম্পূর্ণ প্রভাব এখনো পরিষ্কার নয়। এগুলো আগামী কয়েকদিনের মধ্যে পরিষ্কার হবে। যদি অর্থনৈতিক লেনদেন নিউ ইয়র্ক দিয়ে পাঠাতে হয়, তবে অবশ্যই তাদের ওপর একটি প্রভাব পড়বে। কিন্তু এ পর্যন্ত আমরা যেটি ভাবছি, রূপপুরের ওপর সরাসরি প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন মাসুদ বিন মোমেন। তবে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে আরও কিছু নিষেধাজ্ঞা আসবে এবং যদি নির্দিষ্ট কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আসে, সেক্ষেত্রে হয়তো প্রভাব পড়তে পারে। রূপপুরের ক্ষেত্রে রোসাটোম বড় একটি ভূমিকা পালন করছে। রোসাটোমের ওপর যদি কোনো নিষেধাজ্ঞা আসে সেটি তখন আমাদের জন্য ঝামেলা তৈরি করবে।

কোন মন্তব্য নেই