চট্টগ্রামের হালিশহরে মস্তকবিহীন লাশ
হালিশহরে নালা থেকে উদ্ধার হওয়া মস্তকবিহীন তরুণীর লাশটি এক গৃহবধূর। মোবাইল ফোনে ‘অন্য পুরুষের’ সাথে কথা বলা নিয়ে সন্দেহ থেকে পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করে তার স্বামী। এরপর লাশ গুম করার জন্য শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় মাথা। পরে মাথা ও বাকি দেহ ফেলা আসা হয় পৃথক দুটি স্থানে। আর এই কাজে পাষণ্ড স্বামীকে সহযোগিতা করে প্রতিবেশী এক দম্পতি।
এ ঘটনায় পুলিশ স্বামী জাহিদ হোসেন রাজুকে (২৮) গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারের পর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে রাজু। এদিকে এ খুনের ঘটনায় জড়িত অপর দু’জনকেও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এর আগে গত ২৬ অক্টোবর হালিশহর থানাধীন ছোটপুল ব্রিক ফিল্ড এলাকার একটি ড্রেন থেকে মস্তকবিহীন অবস্থায় ওই তরুণীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। লাশটির মাথা না থাকায় তখন লাশের পরিচয় পাওয়া যায়নি। গতকাল ব্যাপারীপাড়ার একটি কবরস্থান থেকে লাশটির মাথা উদ্ধার করার পর পুলিশ নিশ্চিত হয় লাশটি রাজুর স্ত্রী সুমি ইসলামের (২০)। এ ব্যাপারে হালিশহর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. ওবায়দুল হক গতকাল আজাদীকে বলেন, মস্তকবিহীন লাশটি উদ্ধারের পর আমরা পরিচয় জানার জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করি। এজন্য ওই এলাকায় কয়েকজন লোক লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কারা কারা নিখোঁজ আছে সে বিষয়ে খবর নিতে।
ওসি বলেন, দু’দিন পর আমাদের কাছে খবর আসে এলাকায় সুমি নামে একজন নিখোঁজ রয়েছেন। ওই গৃহবধূর ঘরটিও ছিল তালা মারা। পরে খোঁজ খবর নিয়ে স্বামী জাহিদ হোসেন রাজুর কাছে তার স্ত্রীর অবস্থান জানার চেষ্টা করি। ওসি বলেন, এ সময় রাজু তার স্ত্রী নোয়াখালীতে বেড়াতে গেছে বলে পুলিশকে জানায়। আমরা যোগাযোগের জন্য তার স্ত্রী’র মোবাইল নাম্বার নিই, কিন্তু সবগুলো নাম্বারই বন্ধ পাই। পরে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে রাজু তার স্ত্রীকে খুনের ঘটনাটি স্বীকার করে। ওসি জানান, এ খুনের পেছনে আরও দু’জন সহযোগিতা করেছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। আশা করছি, শীঘ্রই তারা গ্রেপ্তার হবে। ওসি বলেন, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে দাম্পত্য কলহের জেরে এ হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে। মোবাইলে বিভিন্ন সময় কথা বলা নিয়ে স্ত্রীকে সন্দেহ করত রাজু। তার দাবি, সুমি বিভিন্ন ছেলের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলত, পরকীয়া করত।
স্থানীয় কয়েকটি সূত্রে বলা হয়, দেড় বছর আগে খুলনার স্থায়ী বাসিন্দা সুমিকে বিয়ে করে রাজু। ছোটপুলে ব্রিক ফিল্ড এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকত তারা। রাজু পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রী। নিহত সুমি সিডিএ এলাকার একটি বুটিক কারখানায় কাজ করতেন। এছাড়া রাজু’র আরেক স্ত্রী আছে। সে গ্রামের বাড়িতে থাকে। স্থানীয়রা জানান, নিহত সুমি অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। তবে এ বিষয়ে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পরই নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে জানান হালিশহর থানার ওসি।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আমেনা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, বিয়ের পর থেকে মোবাইল ফোনে স্ত্রীর কথা বলা নিয়ে দুইজনের মধ্যে মনোমালিন্য ছিল। এ বিষয়টি রাজু তার প্রতিবেশী বন্ধু জলিল ও তার স্ত্রী ফেরদৌসির সাথে আলোচনার মাধ্যমে খুনের পরিকল্পনা করে। তিনি আরও জানান, রাজুকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার মোবাইলে একটি মেয়ের ছবি পাওয়া যায়। ছবির মেয়েটির হাতে থাকা চুড়ির সাথে মাথাবিহীন মেয়েটির হাতের চুড়ি মিলে যায়। পরে জিজ্ঞাসাবাদের মুখে রাজু সুমিকে হত্যার বিষয়টি স্বীকার করে।
রাজুর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের বরাতে হালিশহর থানার ওসি ওবায়দুল হক বলেন, গত ২৫ অক্টোবর রাতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হয়। তখন সুমিকে মারধরের এক পর্যায়ে রাজু তার গলা টিপে ধরে। সে সময় রাজুর বন্ধু জলিলের স্ত্রী ফেরদৌসি সুমির পা চেপে ধরেছিল। সুমির মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর জলিল লাশ গুম করতে মাথা বিচ্ছিন্ন করার পরামর্শ দেয় রাজুকে। এক সময় কসাইয়ের কাজ করা জলিল ও রাজু মিলে পরে সুমির মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে।
ওসি আরো জানান, রাত দেড়টার দিকে একটি পলিথিন মুড়িয়ে বাজারের ব্যাগে করে বিচ্ছিন্ন মাথাটি ডবলমুরিং থানার বেপারিপাড়া পাইট্টাদিঘীর পশ্চিম পাড় কবরস্থানে ঝোঁপে ফেলে আসে। আর ভোররাতে সুমির মাথাবিহীন দেহ সিমেন্টের বস্তায় ঢুকিয়ে বাসার অদূরে ছোটপুল এলাকার ইসলাম মিয়া ব্রিক ফিল্ডের তিন নম্বর রোডের নালায় ফেলে আসে রাজু ও জলিল। রাজুর স্বীকারোক্তি পাবার পর গতকাল ভোরে সুমির বিচ্ছিন্ন মাথাটি উদ্ধার করে পুলিশ।
এদিকে খুন হওয়ার একদিন আগে নিজ কর্মস্থল থেকে একদিনের ছুটি নিয়েছিলেন সুমি। গত বুধবার শাশুড়ির অসুস্থতার কথা বলে তিনি এ ছুটি নেন বলে জানান কারখানার কর্মচারীরা। ওই বুটিক কারখানার একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজাদীকে বলেন, ‘গত বুধবার সে নিয়মিত কাজে এসেছে। কাজের ফাঁকে হঠাৎ সে বৃহস্পতিবার একদিনের ছুটি চেয়েছিল। নোয়াখালীতে অবস্থিত তার শাশুড়ি নাকি খুবই অসুস্থ। সেখানে তাকে যেতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সুমির স্বামী নাকি তাকে ছুটি নেওয়ার জন্য বলেছিল। কারখানায় লোকজনের সংকট থাকায় আমরা প্রথমে তাকে ছুটি দিতে চাইনি। পরে সে বারবার জোর করায় তাকে একদিনের ছুটি দেওয়া হয়। শুক্রবার কারখানাটি বন্ধ থাকে।’
জাহিদ হোসেন রাজুর বাড়ি খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলায়। গতকাল চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আল ইমরান খানের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে সে।

কোন মন্তব্য নেই