রাইড শেয়ারিং এ নিবন্ধনের আবেদন ১১ কোম্পানির, আরও ১৫টি অপেক্ষায় রয়েছে
২০১৬ সালের নভেম্বরে ঢাকায় অ্যাপভিত্তিক ট্যাক্সি সেবা চালু করে উবার। এর পর পরই মোটরবাইক রাইডশেয়ারিং সেবা নিয়ে আসে ‘পাঠাও’। পরবর্তী সময়ে আরো বিস্তৃত হয় এ সেবার ব্যাপ্তি। শুরুতে যানজট কমিয়ে আনা ও পরিবেশ সুরক্ষার কথা বলে দেশে রাইডশেয়ারিং সেবা চালু হলেও বাস্তবে ব্যক্তিগত মোটরযান ও যানজট কোনোটিই কমছে না। উল্টো দিনে দিনে বাড়ছে সেবাদানকারী কোম্পানির সংখ্যা। রাইডশেয়ারিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘এনলিস্টমেন্ট সার্টিফিকেট’ নিতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছে আবেদন করেছে ১১টি প্রতিষ্ঠান। এর বাইরে আরো অন্তত ১৫টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
জানা গেছে, রাইডশেয়ার সেবা ‘পাঠাও’ নামে নিবন্ধন পেতে আবেদন করেছে পাঠাও লিমিটেড। একইভাবে ‘সহজ রাইডস’ নামে সহজ লিমিটেড, ‘চালাও’ নামে চালডাল লিমিটেড, ‘ফাস্ট ড্রাইভ’ নামে আকাশ টেকনোলজি লিমিটেড, ‘অটোরাইড’ নামে গোল্ডেন রেন লিমিটেড, ‘ওভাই’ নামে ওভাই সলিউশন লিমিটেড, ‘উবার’ নামে উবার বাংলাদেশ লিমিটেড, ‘রাইডার’ নামে রাইডার রাইডশেয়ার এন্টারপ্রাইজ ইনক লিমিটেড, ‘পিকমি’ নামে পিকমি লিমিটেড, ‘ইজিয়ার’ নামে ইজিয়ার টেকনোলজিস লিমিটেড ও ‘গাড়ি ভাড়া’ নামে নিবন্ধন পেতে আবেদন করেছে আকিজ অনলাইন লিমিটেড।
বিআরটিএতে আবেদন করা এ ১১ কোম্পানি ছাড়াও ঢাকা ও ঢাকার বাইরে রাইডশেয়ার সেবা প্রদান করছে আরো অন্তত ১৫টি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হলো— চলো, স্যাম, মুভ, আমার বাইক, ট্যাক্সিওয়ালা, বাহন, আমার রাইড, ঢাকা রাইডার্স, ঢাকা মটো, বিডি ক্যাবস, লেটস গো প্যাসেঞ্জার, ইয়েস বাইক, মেট্রো সিএনজি, ডাকো ও ট্রিপ্পো।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাইডশেয়ারিং কোম্পানির সংখ্যা বেশি হলে সড়কে বিশৃঙ্খলা বাড়বে। পাশাপাশি কোম্পানিগুলোর মধ্যে শুরু হবে অশুভ প্রতিযোগিতা। ধস নামবে সেবার মানে। এজন্য কোম্পানির সংখ্যা সীমিত রাখতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামছুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, বাজার অর্থনীতিতেও একটা নিয়ন্ত্রণমুখী ব্যবস্থা থাকে। যেমন— সেলফোন অপারেটরের সংখ্যা পাঁচ-ছয়টার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। রাইডশেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও এ ধরনের নিয়ম চালু করা উচিত। এর ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো করপোরেট বিনিয়োগ পাবে। তাদের ব্যবসার পরিসর বড় হবে। সেবার মান সন্তোষজনক পর্যায়ে থাকবে। এতকিছুর পরও ব্যবসাটি সহজভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হবে। কিন্তু এটাকে যদি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে এ ব্যবস্থাটি খারাপ পর্যায়ে চলে যেতে পারে। ব্যবসার প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানগুলো নানা ধরনের ছাড় দেবে। সেবার মান ধরে রাখতে পারবে না। সেবার মান ধরে রাখতে হলে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণমুখী ব্যবস্থা রাখতে হবে।
এদিকে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বাণিজ্যিক কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত ঢাকার ব্যক্তিগত মোটরযানের (বাস, হিউম্যান হলার ও অযান্ত্রিক যানবাহন ব্যতীত) ৩৩ শতাংশ চলে গেছে বিভিন্ন রাইডশেয়ার প্রতিষ্ঠানের দখলে। পিআরআইয়ের জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো সৈয়দ মফিজ কামাল ও নূর এ আহসান সম্প্রতি এক নিবন্ধে এ তথ্য প্রকাশ করেন। এতে বলা হয়েছে, রাইডশেয়ারে চলা মোটরসাইকেলের দখলে রয়েছে ২১ শতাংশ ব্যক্তিগত মোটরযান। ১২ শতাংশ রয়েছে রাইডশেয়ারে চলা প্রাইভেট কারের দখলে। এছাড়া সিএনজি চালিত অটোরিকশার দখলে ৬৩ শতাংশ এবং বাকি ৪ শতাংশ রয়েছে অন্য যানবাহনের দখলে।
ওই নিবন্ধে বাংলাদেশে বিদ্যমান রাইডশেয়ার সেবার বাজারমূল্য বছরে ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
মাত্র দুই বছরের মধ্যে বাংলাদেশে দ্রুত বিস্তার ঘটেছে অনলাইনভিত্তিক রাইডশেয়ারিং সেবার। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সব মিলিয়ে ২৫-২৬টি প্রতিষ্ঠান রাইডশেয়ার সেবা প্রদান করছে। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতে রাইডশেয়ারের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে মাত্র পাঁচটি কোম্পানি। অনলাইনভিত্তিক বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টা’র হিসাব বলছে, ভারতের রাইডশেয়ার বাজারে ছড়ি ঘোরাচ্ছে ওলা। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে এই ভারতীয় কোম্পানিটির দখলে রয়েছে দেশটির রাইডশেয়ার বাজারের ৫৬ দশমিক ২ শতাংশ। ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক বহুজাতিক রাইডশেয়ারিং কোম্পানি উবার ভারতে ৩৯ দশমিক ৬ শতাংশ বাজার দখল করে আছে। এর বাইরে জুগনোর ২ দশমিক ৫ শতাংশ, মেরু দশমিক ৮ ও ইক্সিগোর দখলে আছে দশমিক ৯ শতাংশ বাজার। বাংলাদেশেও রাইডশেয়ার বাজারের সিংহভাগ দখল করে আছে পাঠাও, উবার, ওভাই ও সহজ রাইড।
এমন পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে গড়ে ওঠা ২৫-২৬টি রাইডশেয়ার কোম্পানির মধ্যে বাজার দখল নিয়ে অশুভ প্রতিযোগিতা তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিষয়টি সম্পর্কে পরিবহন ও ট্রাফিক ব্যবস্থা বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, রাইডশেয়ার কোম্পানির সংখ্যা বেশি হলে সেগুলোর কারণে সড়কে বিশৃঙ্খলা বেড়ে যেতে পারে। বর্তমানে ঢাকায় বাস কোম্পানি রয়েছে প্রায় ২৮০টি। বিপুলসংখ্যক কোম্পানি হওয়ায় সেগুলোর মধ্যে যাত্রী তোলার জন্য অশুভ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে দেখা যায়। রাইডশেয়ারিং কোম্পানিগুলোর মধ্যে যেন এ ধরনের অবস্থা তৈরি না হয়, সে বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে সচেতন থাকতে হবে।
অ্যাপভিত্তিক রাইডশেয়ারিং সেবাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে এরই মধ্যে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে সরকার, যা গত মার্চ থেকে কার্যকর হয়েছে। ‘রাইডশেয়ারিং নীতিমালা-২০১৭’-এ রাইডশেয়ার সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘রাইডশেয়ারিং সার্ভিস এমন একটি সেবা ব্যবস্থা, যেখানে ব্যক্তিগত মোটরযানের মালিক নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে স্মার্টফোনের মাধ্যমে ব্যক্তিগত মোটরযানকে ভাড়ায় পরিচালনা করে থাকেন।’ বাস্তব চিত্রটি নীতিমালার সঙ্গে অনেকটাই সাংঘর্ষিক। অনেকেই রাইডশেয়ার সেবায় যুক্ত হওয়ার লক্ষ্য নিয়েই ব্যক্তিগত পরিবহন কিনছেন। এক্ষেত্রে তাদের বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যটাই প্রাধান্য পাচ্ছে। মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বেশি।
নীতিমালায় রাইডশেয়ার সেবা চালুর উদ্দেশ্য হিসেবে ‘ব্যক্তিগত মোটরযানের সংখ্যা ক্রমবৃদ্ধির প্রবণতা হ্রাস করা’র কথা বলা আছে। এখানেও ঘটছে উল্টো ঘটনা। আইএ

কোন মন্তব্য নেই