সাড়ে ৩ ঘণ্টার সংলাপ - TIMES EXPRESS | টাইমস এক্সপ্রেস is an interactive news portal

নিউজ ফাস্ট

সাড়ে ৩ ঘণ্টার সংলাপ

গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাড়ে তিন ঘণ্টার বেশি সময় সংলাপ করেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রতিনিধি দল। সংলাপ শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, সংলাপে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। আলোচনা অব্যাহত থাকবে। তবে সংবিধানের বাইরে কিছু নয় গণভবন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু বলেন, ‘বরফ গলতে শুরু করেছে।’ এদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পর অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকেও সংলাপে ডেকেছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। শুক্রবার (আজ) বিকল্প ধারার পর সোমবার জাতীয় পার্টির সঙ্গে বসবেন তিনি। সংলাপের আমন্ত্রণ গেছে বাম গণতান্ত্রিক জোটের কাছেও। খবর বিডিনিউজ ও বাংলানিউজের।
প্রসঙ্গত, নির্বাচন নিয়ে ভিন্ন অবস্থান থেকে আলোচনার জন্য জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে সংলাপের এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। এতদিন আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করে আসা শেখ হাসিনা অপ্রত্যাশিতভাবেই তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে সংবিধানসম্মত বিষয়ে আলোচনার জন্য ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের গণভবনে আমন্ত্রণ জানান। এই সংলাপ শেষে দলের পক্ষে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য নিয়ে গণভবনে সাংবাদিকদের সামনে আসেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে সবার কথা শুনেছেন। কারও কারও কথা তিন-চারবার শুনেছেন। কোনো বাধা দেননি, একটুও অধৈর্য হননি। আমাদের সিনিয়র নেতারাও কথা বলেছেন। তারা কিছু অভিযোগ করেছেন। আমাদের নেতারা তার জবাব দিয়েছেন।’
নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিয়ে ফ্রন্ট নেতারা কথা বলেছেন জানিয়ে কাদের বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সভা-সমাবেশ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। তবে কোনো রাস্তা বন্ধ করে সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটা কর্নার ঠিক করে দেওয়া হবে। সেখানে সব দল সভা-সমাবেশ করতে পারবে। বিনিময়ে একটা কিছু টাকা নেওয়া হবে।’
নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষক রাখার বিষয়েও প্রধানমন্ত্রী একমত হয়েছেন বলে জানান ওবায়দুল কাদের। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ঐক্য ফ্রন্ট নেতাদের সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিয়েছেন জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। নির্বাচনে কোনো হস্তক্ষেপ করা হবে না। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী তাদের বলেছেন, নিরপেক্ষ নির্বাচনের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। সিডিউল ঘোষণার পর সব দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। সুতরাং নির্বাচন নিয়ে শঙ্কার কোনো কারণ নাই। নির্বাচনকালীন সময়ে সরকারের কিছু নেই।’ রাজনৈতিক মামলা প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন, রাজনৈতিক মামলার বিষয়টি তারা তুলে ধরেছেন। এ বিষয়ে মির্জা ফখরুল, কামাল হোসেনকে প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের মামলার তালিকা দিতে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমরা এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবো। ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের বলেছেন, এবার ইভিএম হয়তো নির্বাচন কমিশন সীমিত পরিসরে করবে। এ বিষয়ে আমাদের সম্মতি আছে। আবারো ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপ হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, আলোচনার দুয়ার খোলা থাকবে। ঐক্যফ্রন্ট চাইলে আবারো আলোচনা হবে।
সংলাপে অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীদের নেতা শ ম রেজাউল করিম সাংবাদিকদের বলেন, ‘ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতারা খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি বিচার বিভাগের বিষয়। আদালতের বাইরে এ বিষয়ে তার কিছু করার নেই। ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতারা তত্ত্বাবাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সংবিধানে যা আছে সে অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। সংবিধানের বাইরে কোনো কিছুই হবে না।’
নির্বাচন পেছানোর কথাও ঐক্যফ্রন্ট নেতারা বলেছিলেন জানিয়ে রেজাউল বলেন, ‘এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচন করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। এ ব্যাপারে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে। তার সরকারের কিছুই করার নেই।’
সংলাপে থাকা প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আলোচনা হয়েছে। সংবিধানের মধ্যেই আমরা কথা বলেছি। সংবিধানের আলোকে আলোচনা হয়েছে। আলোচনা গঠনমূলক হয়েছে।’ আলোচনা কি আজই শেষ, না আরও হবে- প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যে কোনো জায়গায় যে কোনো সময় আলোচনা হতে পারে।’
এর আগে বহুল আলোচিত এই সংলাপে যোগ দিতে কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বেইলি রোডে তার বাসা থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সোয়া ৫টার দিকে রওনা হয় ঐক্যফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ। সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে তারা গণভবনে পৌঁছান। এদিকে জাতীয় যুব দিবসের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সন্ধ্যা ৬টায় গণভবনে ফেরেন প্রধানমন্ত্রী। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা পৌঁছানোর পর ব্যাংকোয়েট হলে বসেন। সংলাপের নির্ধারিত সময় সন্ধ্যা ৭টায় সেখানে উপস্থিত হন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি শুরুতেই সবাইকে সালাম জানিয়ে একটি সূচনা বক্তব্য রাখেন।
এরপর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ২০ নেতার সঙ্গে রুদ্ধদ্বার আলোচনা করেন শেখ হাসিনা। তার সঙ্গে ছিলেন ক্ষমতাসীন জোটের ২২ নেতা। রাত ১০টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত এই সংলাপ চলে। সংলাপ শেষে প্রথমেই বেরিয়ে যান জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এরপর একে একে অন্য নেতারা বেরিয়ে আসেন।
গণভবন রওনা হওয়ার আগে বিকাল সাড়ে ৪টায় কামাল হোসেনের বাড়িতে পৌঁছে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। এর পৌনে এক ঘণ্টা পর তারা রওনা হন। কামালের বাড়িতে বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর থাকলেও প্রতিনিধি দলে থাকা বিএনপির অন্য নেতারা ছিলেন না। তারা আলাদাভাবে গণভবনে পৌঁছান। এর মধ্যে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের নাম প্রতিনিধি দলে থাকলেও তিনি সংলাপে যাননি। সবাই পৌঁছে যাওয়ার ১৫ মিনিটের বেশি সময় পর গণভবনে ঢোকেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না।
সংলাপে কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রতিনিধি দলে ছিলেন বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মওদুদ আহমদ, জমিরউদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সদস্য সচিব আ ব ম মোস্তফা আমীন, সাবেক দুই সংসদ সদস্য এস এম আকরাম ও সুলতান মো. মনসুর আহমেদ, জাফরুল্লাহ চৌধুরী, জেএসডির আ স ম আবদুর রব, তানিয়া রব, আবদুল মালেক রতন, গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী, মোস্তফা মহসিন মন্টু, আ ও ম শফিকউল্লাহ, মোকাব্বির খান, জগলুল হায়দার আফ্রিক এবং নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না।
সংলাপে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২৩ সদস্যের প্রতিনিধি দলে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদের, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মোহাম্মদ নাসিম, কাজী জাফর উল্যাহ, আবদুল মতিন খসরু, মো.আব্দুর রাজ্জাক, রমেশ চন্দ্র সেন, আনিসুল হক, মাহাবুব-উল আলম হানিফ, আবদুর রহমান, দীপু মনি, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুস সোবহান গোলাপ, শ ম রেজাউল করিম, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু, মইনুদ্দিন খান বাদল, সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া।
সংলাপের শুরুতেই আওয়ামী লীগের ১০ বছরের শাসনকালের মূল্যায়ন করে দেখতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
ব্যাংকোয়েট হলে প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত হয়ে সবাইকে সালাম দিয়ে আসন গ্রহণ করেন। সূচনা বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘গণভবন জনগণের ভবন, এখানে আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি, আজকে অনুষ্ঠানে যে আপনারা এসেছেন। আমি এটুকু বলতে পারি যে বাংলাদেশের জন্য আজকে আমরা যে আর্থ সামাজিক উন্নয়ন করে যাচ্ছি এবং দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রেখেছি, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের এ উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখবে বলে মনে করি। এছাড়া এই দেশটা আমাদের সকলের। মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং দেশের সার্বিক উন্নয়ন এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য।’ শেখ হাসিনা ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি এটার বিচার আপনাদের উপরই ছেড়ে দেব। (আমাদের ক্ষমতা গ্রহণের পর) নয় বছর ১০ মাস হতে চলল আমরা সরকারে, এই সময়ের মধ্যে দেশের কতটুকু উন্নয়ন করতে পেরেছি, সেটা নিশ্চয় আপনারা বিবেচনা করে দেখবেন। তবে এটুকু বলতে পারি, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ভালো আছে, তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে। দিন বদলের যে সূচনা আমরা করেছিলাম, দিন বদল হচ্ছে এটাকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করা, লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীনতা। আমাদের মহান নেতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আজকে সে স্বাধীনতার সুফল যেনো প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছাতে পারি সেটাই একমাত্র লক্ষ্য, আর সে লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করছি।’
প্রধানমন্ত্রীর সূচনা বক্তব্যের পর রুদ্ধদ্বার সংলাপ শুরু হয়।

কোন মন্তব্য নেই