জাদু নিয়ে কিছু কথা - TIMES EXPRESS | টাইমস এক্সপ্রেস is an interactive news portal

নিউজ ফাস্ট

জাদু নিয়ে কিছু কথা






বর্তমান বিশ্বের সর্বত্রই জাদুর কারিশমাকে অধিকতর জনপ্রিয় করার জন্য প্রচারমাধ্যমগুলো উঠে পড়ে লেগেছে। এটা একটা ভয়ঙ্কর আত্মবিনাশী পাঁয়তারা। তা থেকে নিজেদেরকে এবং কোমলমতি ছেলে-মেয়েদের এমনকি পরিবার-পরিজনদের রক্ষা করা একান্ত দরকার। এই দরকারি কাজটার প্রতি অবহেলা প্রদর্শনের কোনোই অবকাশ নেই।

জাদুকে আরবি ভাষায় ‘সিহির’ বলে। বস্তুত সিহির ওই বস্তু যার কার্যকারণ তো আছে, কিন্তু তা প্রকাশ নয় বরং গোপন। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় এমন অপূর্ব অভিনব কর্মকে সিহির বলে, যার জন্য জিন ও শয়তানদের খুশি করে তাদের নিকট থেকে সহযোগিতা গ্রহণ করা হয়।



আল্লামা আলুমী রহ. এ বিষয়টিকে আরও খোলাসা করে বলেছেন, সাহারা ইয়াসহার বাবে ফাতাহা ইয়াফতাহু এর ওজনে সম্পাদিত। এর মাছদার বা শব্দমূল হলো ‘সিহরুন’। অর্থ সূ² ও গুপ্ত বিষয় প্রকাশ পাওয়া। যে কাজের কার্যকারণ অত্যন্ত সূ² ও গুপ্ত তা-ই সিহির বা জাদু। পরিভাষায় জাদু বলতে এমন আশ্চর্য কাজ বুঝায়, যা খারিকলিল আদাত অর্থাৎ সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম কাজের সাথে বাহ্যিক সাদৃশ্য রাখে। প্রকৃতপক্ষে এর সাথে মুজিজাহ বা কারামতের কোনোই সম্পর্ক নেই। কারণ জাদু শিক্ষাযোগ্য বস্তু ও বিষয়, যা অন্যের নিকট থেকে শিখতে হয় এবং যা অর্জন করতে শয়তানের নৈকট্যমূলক কাজের মাধ্যমে তার সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করতে হয় (নাউজুবিল্লাহ)। (তাফসিরে রহুল মায়ানী : খন্ড ১, পৃ. ৩৩৮)।

জাদুতে জিনকে রাজিখুশি করার বিভিন্ন রূপ হয়ে থাকে। যেমন- ক. কুফর ও শিরকের শব্দে মন্ত্রপাঠ করা এবং শয়তানের স্তবস্তুতি, গুণকীর্তন করা। খ. নক্ষত্রের পূজা-উপাসনা করা। এর ফলে শয়তান ভীষণ খুশি হয়। গ. এমন সব কাজকর্ম করা, যা আল্লাহপাকের নিকট অতি অপ্রিয় ও ঘৃণ্য। এতে শয়তান ভারি খুশি ও আনন্দিত হয়। যেমন কাউকে বিনা বিচারে অন্যায়ভাবে হত্যা করে তার রক্ত দিয়ে তাবিজ লেখা অথবা জীবন্ত মানুষ, হাস-মুরগির অঙ্গ ছেদ করে তার রক্ত দিয়ে তাবিজ লেখা, পরপর অপবিত্র বা জানাবাতের অবস্থায় থাকা, জাদুকর মহিলার ঋতুর সময় জাদু করা এবং পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা থেকে দূরে থাকা ইত্যাদি। সাধারণ মানুষ দেখে, জাদুকরের কীর্তিতেই যেন এ কাজ সমাধা হচ্ছে। আসলে তা গোলকধাঁধা বা নজরবন্দী মাত্র।

আল্লামা আলুসী রহ. উপরোক্ত বিবরণের বিশ্লেষণ করে বলেছেন, জাদু শিখতে শয়তানের নৈকট্যমূলক কাজের মাধ্যমে তার সহযোগিতা কামনা করা হয়। যেমন মন্দ কথা বলা, এর উদাহরণ হলো এমন বাক্য বা কালাম দ্বারা ঝাড়ফুঁক করা; যাতে শিরকের শব্দ আছে অথবা শয়তানের প্রশংসা আছে, অথবা মন্দকাজ করে শয়তানের নৈকট্য লাভ করা; যেমন- তারকা পূজা করা, শরীয়তবিরোধী সাহচর্য অবলম্বন করা ইত্যাদি। শুধু তা-ই নয়, ইতিকাদ ও বিশ্বাসের দিক থেকে মন্দকাজ করা, যেমন- যে কাজ দ্বারা শয়তানের নৈকট্য লাভ করা যায়, তা উত্তম মনে করা এবং এ জাতীয় ব্যক্তির সাথে বা কাজের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক ও ভালোবাসা রাখা। (তাফসীরে রুহুল মায়ানী : খন্ড ১, পৃ. ৩৩৮)।

জাদুকরদের বদ আমলের জন্য জিন ও শয়তানেরা যেমন তাদের সাহায্য করে এবং তাদের কাজ সমাধা করে দেয়, অনুরূপভাবে আল্লাহপাকের ফেরেশতাগণ সৎ ও পুণ্যবান মানুষের আল্লাহভীতি, পবিত্রতা, সৎকর্ম সম্পাদন এবং অসৎকর্ম থেকে আত্মরক্ষার জন্য আনন্দিত ও খুশি হন। আল্লাহপাকের দরবারে তারা তাদের সে খুশি ব্যক্ত করেন। তখন আল্লাহপাকের নির্দেশে তারা পুণ্যবান বান্দাদের সাহায্য করেন এবং তাদের কাজ সমাধা করে দেন। 


আল্লামা আলুসী রহ. এর ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেন যে, দু’টি বস্তুর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের পূর্বশর্ত হলো, উভয়ের মধ্যে মিল ও পারস্পরিক সহযোগিতা। সুতরাং ফেরেশতাগণ যেমন কাজে ও কথায় আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্যে আত্মনিবেদিত, তেমনি ফেরেশতা স্বভাবসম্পন্ন সৎ ও উত্তম ব্যক্তিগণ ছাড়া তারা অন্য কাউকে সাহায্য করে না। অপরদিকে জিন ও শয়তানের কাজ, কথা ও ধ্যানধারণায় তাদের মতো খবিস ও দুশ্চরিত্র লোক ছাড়া অন্য কাউকে সহযোগিতা করে না। (তাফসীরে রুহুল মায়ানী : খন্ড ১, পৃ. ৩৩৮)।


যাদুর দ্বারা কোনো কোনো সময় বস্তুর আসল রূপ বা মৌলিক আকৃতি পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। যেমন- হাঁস, মুরগি, কবুতর, বিড়ালকে পাথর বা অন্য কোনো প্রাণীকে রূপান্তরিত করা ইত্যাদি। আসলে এই ব্যাপারটি শুধু নজরবন্দি পর্যায়ের হয়ে থাকে। যাদুকর লোকদের চোখে এমনি একটি প্রভাব ফেলে যে, মানুষ অনুপস্থিত বস্তুকে উপস্থিত; অস্তিত্বহীন বস্তুকে অস্তিত্বসম্পন্ন মনে করে আর এটাকেই বাস্তব রূপ বলে ধারণা করে। আবার যাদুকর কখনো কখনো কাল্পনিক ক্ষমতার দ্বারা উপস্থিত মানুষের মন মস্তিষ্কের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। যার ফলে যা অনুভবযোগ্য নয় এমন বস্তুকে অনুভবযোগ্য বলে খেয়াল করতে থাকে।

এ প্রসঙ্গে আল্লামা বাগাভী রহ. সংক্ষেপে যা উল্লেখ করেছেন, তা খুবই প্রণিধানযোগ্য। তিনি উল্লেখ করেছেন, বলা হয়ে থাকে যে, কোনোও প্রাণীর অন্তরে প্রভাব ফেলে যাদুকর ছাগলকে গাধার রূপে, গাধাকে কুকুরের রূপে পরিবর্তিত আকারে দেখাতে পারে, এটাকে সম্মোহন বলে। তবে অধিকতর সঠিক কথা হলো এই যে, এ সবই কল্পনার সাথে সংশ্লিষ্ট। বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক এখানে নেই। (তাফসিরে বাগাভী : খন্ড ১, পৃ. ৯৯)।



যাদু ও দৃষ্টি দোষ বা দৃষ্টি বিভ্রাট সত্য। এর দ্বারা আকস্মাৎ মৃত্যু পর্যন্ত সংঘটিত হতে পারে। যাদুর প্রভাবে সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। যাদু মানুষের অন্তরে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে তার মানসিক ঝোক পরিবর্তন করে দিতে পারে। এমন কি কোনো দুষ্টু যাদুকর যাদুর দ্বারা অন্যকে হত্যা করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। এর বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আল্লামা বাগাভী রহ. বলেছেন, বিশুদ্ধ কথা হলো এই যে, সিহির বা যাদু মূলত তামার ওপর স্বর্ণের ভুয়া রং তুল্য প্রতারণা ও ফাঁকিবাজি কারবার। ধোকা দেয়া, কল্পনায় প্রভাব ফেলে বিভ্রন্ত করাই এর আসল উদ্দেশ্য।

আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের অভিমত হলো এই যে, যাদুর অস্তিত্ব আছে। জমহুর উম্মত ও অভিমতই পোষণ করেন। কিন্তু যাদুর আমল করা আন্যের ওপর যাদু করা কুফুরি কর্ম। যা নির্ঘাত হারাম! হারাম!! হারাম। যারা এই কুফুরি কর্মে পরিলিপ্ত তারা আদৌ ঈমানদারদের পর্যায়ভুক্ত নয়।

এ প্রসঙ্গে ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেছেন, যাদু কল্পনায় প্রভাব বিস্তার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে, প্রতারণা করে ও অুসস্থ করে তোলে। এমন কি কোনো কোনো সময় মৃত্যুর মুখেও ঠেলে দেয়। (তাফসিরে বাগাভী : খন্ড ১, পৃ. ৯৯)।

যাদুর কতিপয় কুফুরি বাক্য খুবই ক্রিয়াশীল। অনেক সময় মানুষ যাদুর কুফুরি বাক্যের প্রভাবেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে আল্লামা বাগাভী লেখেন, যাদুর কুফুরি বাক্যের প্রভাবে কিছু লোক মৃত্যুর মুখোমুখিও হয়েছে। যাদুর কিছু মন্ত্র এমনও আছে, যা সংক্রামক ব্যাধির মত মানুষের দেহে দারুণভাবে প্রভাব বিস্তার করে। 


আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যাদুকর বা তাদের যাদুর প্রভাব অন্যের প্রতি বিস্তার করে।’ এতে করে যাদু দেহের ওপর রোগ-ব্যাধি, মস্তিষ্ক বিকৃতি ইত্যাদিরূপে ক্রিয়া করে। দেহ ও মনের ওপর যাদুর কথা বা মন্ত্রের তাছির ও প্রভাব পড়ে। মানুষ কখনো অনাকাক্সিক্ষত কিছু শুনে জরাক্রান্ত হয়ে পড়ে। কিছু কিছু লোক তাদের শ্রুত কথার ধাক্কায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে বলেও জানা যায়। সুতরাং যাদু এমন এক অদৃশ্য বস্তু ও সংক্রামক রোগস্বরূপ যা মানব দেহে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে থাকে। (তাফসীরে বাগাভী : খন্ড ১, পৃ. ৯৯)।

নবী ও রাসূলগণের ওপরও যাদু করা যায়। নবী ও রাসূলগণের ওপরও যাদু ক্রিয়া করতে ও প্রভাব বিস্তার করতে পারে। কারণ যাদু তো গুপ্ত ও গোপন কার্য কারণের আছর। আর কোনো কার্য কারণের প্রভাব প্রভাবিত হওয়া নবী ও রাসূলগণের পদ মর্যাদা ও শানের প্রতিবন্ধক নয়। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ওপর ইয়াহুদী মহিলা কর্তৃক যাদু করা, তার ওপর যাদুর আছর প্রকাশ পাওয়া, ওহীর মাধ্যমে তাকে এ বিষয়ে অবহিতকরণ, যাদুর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া বিনষ্ট করার নীতি পদ্ধতি তাকে অবহিতকরণ ইত্যাদি বিষয় বিশুদ্ধ হাদীসসমূহে বিবৃত হয়েছে।

আর যাদুকরদের যাদুর দ্বারা প্রথম পর্যায়ে হযরত মূসা (আ.)-এর প্রভাবিত ও ভীত হওয়ার বর্ণনা কোরআনুল কারীমে বিদ্যমান আছে। সূরা ত্বাহা এর ৬৬-৬৮ নং আয়াতে এবং রাসূলুল্লাহ সা. কে ইয়াহুদী কর্তৃক যাদু করার ঘটনাটি আয়েশা (রা.)-এর বর্ণিত দীর্ঘ হাদীস সহীহ বুখারীর ১ম খন্ডে ৮৫৮ পৃষ্ঠায় সন্নিবেশিত হয়েছে।


কোন মন্তব্য নেই