শতক লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে গোমতী বাঁধের জমি
আড়াই শতক, আড়াই লাখ। এ হিসাবে লাখ টাকায় শতক। দরিদ্র দিনমজুর রফিকুল ইসলাম এ দামেই কিনেছেন বেড়িবাঁধের জমি। স্ট্যাম্পে লিখিত আকারে এ জমির দখল বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে। এভাবে স্ট্যাম্পে লিখিত থাকলেই সরকারি জায়গার মালিক হওয়া যায় কি-না, এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই তার। তবে পরিবার নিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়, এতেই খুশি সে। গোমতী নদীর বাঁধের কুমিল্লা সদর উপজেলার চানপুর বেইলি ব্রিজের এক-দুইশ' গজ দূরেই পাশাপাশি ছয় পরিবারের বাস। তারাও একইভাবে দখলদার। চানপুরের রাজা মিয়া টাকা নিয়ে স্ট্যাম্প করে দিয়েছে, দখলও বুঝিয়ে দিয়েছে। ছয় পরিবার মিলে একটা সমাজও হয়েছে। এক বছর আগে তারা স্ট্যাম্প করেছেন। তবে স্ট্যাম্পে লেখা শর্ত, এ জায়গা নিজের বলে কেউ দাবি করতে পারবে না। সরকার চাইলেই ছেড়ে দিতে হবে। এভাবেই গোমতী নদীর বাঁধে গড়ে উঠেছে অবৈধ দখল-বসতি।
বাঁধের চানপুর এলাকার স্ট্যাম্পদাতা রাজা মিয়াকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। পাশের পাঁচথুবী ইউনিয়নের বাসিন্দা মিজানুর রহমান দোকান করতে বাঁধের জায়গা দখল নিয়েছেন। এলাকার বাবুল মিয়া দখল বুঝিয়ে দিয়েছে। একেবারে বাঁধসংলগ্ন হওয়ায় দর বেশি দিতে হয়েছে শতকে দেড় লাখ টাকা। বাঁধের পাশের জায়গা সমতল করতে ভরাট করে নিতে হয়েছে নিজ খরচে। অবশ্য স্ট্যাম্পদাতা বাবুল মিয়া অভিযোগ অস্বীকার করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড এমন তিন হাজার ১৭ অবৈধ দখলদারের তালিকা করেছে। অবৈধ দখলের স্থান চিহ্নিত হয়েছে ঠিকই; কিন্তু আড়ালে থেকে গেছে টাকার বিনিময়ে দখল বুঝিয়ে দেওয়া দাতাদের নাম। গত ২২ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে গোমতী নদী রক্ষা নিয়ে বৈঠক হয়। বৈঠকে আসা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুই কর্মকর্তা জানান, উচ্ছেদ অভিযানে যেতে তিন হাজার ১৭ জন দখলদারের তালিকা জেলা প্রশাসকের কাছে জমা দিয়েছেন তারা।
বাঁধের দু'পাশে সংযোগ সড়ক হওয়ায় যানবাহন চলাচল ও মানুষের সমাগম বেড়েছে। বেশক'টি ব্রিজ নির্মাণ হওয়ায় দু'পাশের মানুষের যাতায়াত আরও বেড়ে গেছে। ব্রিজে ও বাঁধ সড়কে দৃষ্টিনন্দন বাতি স্থাপন করায় বিকেল-সন্ধ্যায় বেড়াতে আসছেন মানুষ। তাই গড়ে তোলা হচ্ছে অবৈধ দোকানপাটও। সরেজমিন দেখা যায়, কুমিল্লার টিক্কারচর ব্রিজ থেকে আলেখাঁরচর আমতলী ব্রিজ পর্যন্ত নদীর দু'পাশের বাঁধে ছোট-বড় কাঁচা-পাঁকা ঘরবাড়ি ও বাঁধের ওপর দোকানপাট নির্মাণ-দখলের হিড়িক চলছে। কেউ টিনশেডের ঘর নির্মাণ করে বসতি শুরু করেছে, কেউ আবার কাঁচা-পাকা ঘর আর কেউ ইটের ওপরে টিন দিয়ে সেমিপাকা ঘর নির্মাণ করে বসতি নির্মাণ করেছে। কেউ বাঁশের বেড়ার সীমানা দিয়ে ঘিরে নিয়েছে। শাকসবজি ফলাচ্ছে। আবার কেউ বসত নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে মাটি ভরাট করে দোকান নির্মাণ করে ব্যবসা চালাচ্ছে।
নদীরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করার সময় সরকার যাদের কাছ থেকে জায়গা ক্রয় করেছে, তারা এখনও দখল ছাড়েনি। শুধু তাই নয়, ওই দখলদারদের অনেকেই লাখ-দেড় লাখ টাকায় শতক বুঝিয়ে দিচ্ছে।
সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সাবেক সভাপতি শাহ মো. আলমগীর খান বলেন, অবৈধভাবে চর কেটে, মাটি-বালু উত্তোলন, নদীরক্ষা বাঁধে বসত-দোকান নির্মাণ ও চর দখল করে বাড়িঘর নির্মাণে সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে গেছে গোমতীর। হুমকির মুখে পড়েছে নদীরক্ষা বাঁধ ও তার পরিবেশ। বলা চলে, অবৈধ বসতির কারণে নদীর চর-বাঁধ এখন গ্রামে পরিণত হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ বলেন, গোমতীর উৎস ভারতে। কুমিল্লায় প্রবেশ করেছে কটক বাজার সীমান্ত দিয়ে। প্রায় ১৪৪ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে দাউদকান্দির মেঘনায় গিয়ে মিলেছে নদীটি। দু'পাড়ে তিন হাজার ১৭ জন অবৈধ দখলদারের তালিকা জেলা প্রশাসকের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। এসব দখলদার বাঁধের বিভিন্ন অংশ কেটে ফেলছে। এতে বাঁধ সরু ও দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। খুব শিগগির আমরা উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে।
জেলা প্রশাসক আবুল ফজল মীর জানান, দখলদারদের উচ্ছেদে পানি উন্নয়ন বোর্ড তালিকা দিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড যখনই চাইবে, উচ্ছেদে যেতে পারবে। আমরা সবধরনের সহযোগিতা করবো।

কোন মন্তব্য নেই