শামীম ওসমানের সাথে তার মনস্তাত্তি¡ক লড়াই :যেভাবে পতন এসপি হারুনের - TIMES EXPRESS | টাইমস এক্সপ্রেস is an interactive news portal

নিউজ ফাস্ট

শামীম ওসমানের সাথে তার মনস্তাত্তি¡ক লড়াই :যেভাবে পতন এসপি হারুনের



অবেশেষে এক শিল্পপতির কাছে চাঁদা দাবির অভিযোগকে কেন্দ্র করে সাজানো মাদক ও অস্ত্র মামলায় নিজেই ফেঁসে গেলেন পুলিশের আলোচিত কর্মকর্তা এসপি মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ। নারায়ণগঞ্জে যোগদানের পর সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে ব্যাপক আলোচনায় আসেন তিনি। ১১ মাসের মাথায় তাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ সদর দফতরে এসপি (টিআর) বদিল করা হয়। এই ১১ মাস নারায়ণগঞ্জ থাকাকালে এসপি হারুন জন্ম দিয়েছেন অনেক রঙ-বেরঙের ঘটনা। তেমনি তার হঠাৎ করে প্রত্যাহার হওয়ায় অনেকে বিস্মিত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে গত রোববার রাত থেকে এসপি হারুনের বদলি টক অফ দ্য টাউন ছিল। তার পক্ষে-বিপক্ষে নানা মন্তব্য করেছেন বিভিন্ন মানুষ।

২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ যোগদান করেন এসপি হারুন। জাতীয় নির্বাচনে কিছু দিন আগে তার যোগদানকে অনেকে ভিন্নভাবে দেখে। ২১ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জে বন্দরে একটি নির্বাচনী সভায় যাওয়ার পথে হামলার শিকার হয় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের গাড়িরবহর। তখন এসপি হারুন নিজে ঘটনাস্থলে গিয়ে মির্জা ফখরুলকে পুলিশ পাহারায় জনসভার স্থলে পৌঁছে দেন। নির্বাচনের আগে এসপি হারুনের এমন ঘটনা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। মূলত নির্বাচনের আগে মানুষের বিশ্বাস অর্জনের জন্য এমন কাজটি তিনি করেছেন বলে অনেকে মন্তব্য করেন।

নির্বাচনের পর বেশ ভালোই কাটতে থাকে এসপি হারুনের দিনকাল। কয়েক মাস পরই শুরু হয় নারায়ণগঞ্জের আলোাচিত সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের সাথে তার মনস্তাত্তি¡ক লড়াই।

১ এপ্রিল রাতে ফতুল্লার পাগলা বাজার মেরিএন্ডারসন থেকে বিপুল মদ বিয়ারসহ ৬৮ জনকে আটক করে পুলিশ। ওই মাদকের সাথে শামীম ওসমানের শ্যালক তানভীর রহমান টিটু জড়িত বলে প্রেসব্রিফিং করে জানায় পুলিশ সুপার।
এর আগে শামীম ওসমানের একনিষ্ঠ সহচর মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজামের বিরুদ্ধে ২৯ মার্চ জিডি করে ফতুল্লা থানার ওসি শাহ মঞ্জুর কাদের। এ ছাড়া শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠজন নারায়ণগঞ্জ হোসিয়ারি সামিতির সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি নাজমুল আলম সজলকে একটি অপহরণ মামলায় জড়ানো হয়। এ ছাড়া মারামারির ঘটনায় দুইজন কাউন্সিলরকে মানুষের সামনে হাতকড়া পরিয়ে থানায় নেয়ার ঘটনায় পুলিশের কঠোর সমালোচনা করেন শামীম ওসমান। এসপি হারুনের সাথে দ্ব›েদ্বর জেরে নারায়ণগঞ্জে বিশাল জনসমাবেশ করে শক্তি জানান দেন শামীম ওসমান।

তবে এসপি হারুন মাদক সন্ত্রাস চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করেন। এ ছাড়া ভুক্তভোগীদেরকে তার সাথে সাক্ষাতের সুযোগ করে দিয়ে শহরের মানুষের কাছে বাংলার সিংহ উপাধি পান। তাকে নিয়ে ব্যানারও হয় নারায়ণগঞ্জে।
অপশক্তির বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে আড়ালে তিনি নিজেই জড়িয়ে পড়েন নানা বিতর্কে। তার কয়েকটি অভিযান জন্ম দেয় নানা বিতর্কের।

গত ১ অক্টোবর রাতে রূপগঞ্জের তারাবো পৌরসভার রসুলপুর এলাকার একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে এক কোটি ২৫ লাখ টাকা ও দুই হাজার পিস ইয়াবাসহ ‘মাস্টার মশার কয়েল’ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জামাল হোসেন মৃধাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ ঘটনায় এসপি হারুন প্রেস ব্রিফিং করে জানান, জামাল মৃধা তার টাকার উৎস বলতে পরেনি। এসব টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করার জন্য প্রস্তুত ছিল। তবে জামাল হোসেনের মৃধার পরিবারের দাবি, পুরো ঘটনাটি পুলিশের সাজানো নাটক। জামাল মৃধা একজন পরহেজগার এবং ভালো লোক হিসেবে তার এলাকায় পরিচিত।
জামাল মৃধার বড় ভাই লাভলু মৃধা বলেন, আমার ভাই মাস্টার মশার কয়েল প্রতিষ্ঠান করে সারা দেশে নাম ডাক করেছে। সারা দেশেই তার ডিলার রয়েছে। কোটি টাকার ব্যবসা হয়। এ ছাড়া তার গরুর ফার্ম আছে।

এবার কোরবানিতেও কোটি টাকার গরু বিক্রি করেছে। অথচ পুলিশ বলে সে মাদকের ব্যবসায় করে। তাকে ফাঁসিয়েছে। অভিযানের সময় তারা বাড়ির সিসি ক্যামেরা এবং এর রেকর্ড ডিভাইজ ভেঙে নিয়ে এসেছে। আইনজীবী বলছেন সেগুলো জব্দ দেখায়নি। পুলিশ বাড়িতে গিয়ে কী অভিযান চালাইছে তা ওই ভিডিও দেখলেই বের হয়ে যাবে। তাই তারা সেগুলো সরিয়ে নিয়েছে। যে কারো প্ররোচনায় পুলিশ এই অভিযান চালিয়ে আমার ভাইকে ফাঁসিয়েছে।
আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন বলেন, মামলা সংশ্লিষ্ট নথি, এজহার, ফরওয়ার্ডিং, জব্দ তালিকা আসামিপক্ষের আইনজীবীদের দেখতে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে চরম গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়েছে। আমরা আসামিপক্ষের আইনজীবীরা এটিকে অস্বাভাবিক ও প্রশ্নবোধক বলে মনে করি। এই মামলায় সবকিছুতেই লুকোচুরি লুকোচুরি ভাব।

আসামিপক্ষের মূল আইনজীবী অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান দিপু বলেন, সারাদেশে দুর্নীতি ও মাদকবিরোধী অভিযান চলছে। আমরা এবং সাধারণ মানুষ দুর্নীতি ও মাদকবিরোধী অভিযানকে স্বাগত জানাই। কিন্তু প্রত্যেকটি ভালো কাজ কিংবা উদ্যোগ কিছু অতিউৎসাহী মানষ, কর্মকর্তার জন্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। এই মামলাটি তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, পুলিশ মাদক বিক্রির যে টাকা জব্দ করেছে বলছে, তা জমি মূলত তার জমি বিক্রি ও গরু বিক্রির টাকা।
উল্লেখ্য, ২ অক্টোবর সিদ্ধিরগঞ্জে নকল প্রসাধনী ও নকল স্টিকার লাগানো ইলেকট্রনিকস পণ্য তৈরির কারখানায় অভিযান চালায় পুলিশ। প্রায় ৭০ কোটি টাকা মূল্যের বিপুল পরিমাণ নকল প্রসাধনী ও নকল স্টিকার লাগানো টিভি জব্দ করেছে দাবি করে নারায়ণগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় জড়িত আটজনকে আটক করা হয়েছে। এ অভিযান নিয়ে বিতর্কের ঝড় ওঠে। ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়া এমন অভিযান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অনেকে।

তবে এই দুটি অভিযানের বিতর্ক যখন ওঠে তখন এসপি হারুন বলেন, আমাদের তো আইন শিখাইয়া লাভ নেই। আইনে যদি কাভার না করে তাহলে যা ভালো হয় তাই করব। আমরা যদি খারাপ লোকদের ধরতে যাই যদি সাংবাদিকের হেল্প লাগে, হেল্প চাইবো। খারাপ লোকের বিরুদ্ধে তো আমি ছাড় দেব না। আমাদের কাছে অপরাধী মনে হয়েছে আমরা মামলা রুজু করেছি। এটি নিয়ে বেশি আর ব্যাখ্যা দিতে চাই না।

সবশেষে শনিবার ভোর রাতে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী পারটেক্স গ্রæপের চেয়ারম্যান এম এ হাশেমের পুত্রবধূ এবং নাতিকে গুলশান বাসা থেকে আটক করে নিয়ে যাওয়া এবং তার পুত্র বিসিবির সাবেক পরিচালক শওকত আজিক রাসেলের গাড়ি থেকে মাদক ও অস্ত্র উদ্ধার দেখানোর ঘটনায় ফেঁসে যান এসপি হারুন। এ ঘটনায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়। একটিতে প্রধান আসামি করা হয় শিল্পপতি শওকত আজিজ রাসেলকে। গতকাল ওই মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেন।

অভিযানের একটি ভিডিও প্রকাশ হওয়ার পর পুরো ঘটনাটি এসপি হারুনের, সাজানো ছিল এমনটা ফাঁস হয়ে যায়। ওই শিল্পপতির কাছে চাঁদা দাবি করেন এসপি হারুন এমন খবরও প্রকাশ পায়। ফলে তাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।

প্রত্যাহারের ব্যাপারে হারুন অর রশীদ গণমাধ্যমকে বলেন, সরকার মনে করেছে তাই সরিয়েছে। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, কারণ নিশ্চয় আছে, তাই সরানো হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই