খুব প্রয়োজন না হলে ইলেকট্রনিক পণ্য কিনছে না মানুষ - TIMES EXPRESS | টাইমস এক্সপ্রেস is an interactive news portal

নিউজ ফাস্ট

খুব প্রয়োজন না হলে ইলেকট্রনিক পণ্য কিনছে না মানুষ













গরমে এয়ারকন্ডিশনার, রেফ্রিজারেটরের মতো ইলেকট্রনিক পণ্যের চাহিদা বাড়ে। এপ্রিল থেকে বেচাকেনা বাড়তে থাকে এসব পণ্যের, জুন পর্যন্ত ক্রেতার ভিড় থাকে দোকান বা শোরুমে। সারা বছর যত এয়ারকন্ডিশনার ও রেফ্রিজারেটর বিক্রি হয়, তার সিংহভাগই হয় এই তিন মাসে। তবে এবারের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। করোনাভাইরাসের কারণে এপ্রিল ও মে পুরো দুই মাস কোনো বেচাকেনাই হয়নি। জুন থেকে বাজার কিছু সচল হলেও ব্যবসায়ীরা বলছেন, এয়ারকন্ডিশনার, রেফ্রিজারেটরের মতো পণ্যের বিক্রি কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ। অন্য ইলেকট্রনিক পণ্যের ব্যবসায়ও মন্দা। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে মানুষ এখন ইলেকট্রনিক পণ্য কিনছে না।

দেশে ইলেকট্রনিক পণ্যের বাজারে ভিশন, মিনিস্টার, ওয়ালটন, ইউনিটেক, যমুনার মতো দেশী প্রতিষ্ঠান যেমন আছে, তেমনি রয়েছে বিদেশী সনি, শার্প, স্যামসাং, এলজির মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানও। এসব ইলেকট্রনিক পণ্যের মধ্যে আছে টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর, এয়ারকন্ডিশনার, ওয়াশিং মেশিন, মোবাইল ফোন, সাউন্ড সিস্টেম, ক্যামেরা, ইস্ত্রিসহ বিভিন্ন গৃহস্থালি সামগ্রী। করোনার প্রভাবে সব প্রতিষ্ঠানেরই পণ্য উৎপাদন, বাজারজাত ও বিপণনে ধাক্কা লেগেছে।

দেশে রেফ্রিজারেটর বাজারের সবচেয়ে বড় মার্কেটশেয়ার ওয়ালটনের। করোনা পরিস্থিতির সরাসরি ধাক্কা লেগেছে প্রতিষ্ঠানটির রেফ্রিজারেটর বিক্রিতে। সাধারণ ছুটির দুই মাস সারা দেশে ওয়ালটনের ১৭ হাজারের বেশি আউটলেটে বেচাকেনা ছিল শূন্যের কোটায়। এখন কিছুটা বেচাকেনা শুরু হলেও যেসব এলাকা নতুন করে লকডাউনের মধ্যে পড়েছে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেসব এলাকার ব্যবসা।

ব্যবসার কী হাল জানতে চাইলে ওয়ালটনের নির্বাহী পরিচালক উদয় হাকিম বলেন, আমরা যেসব পণ্য তৈরি করি, সেগুলো এক অর্থে বিলাস পণ্য। করোনার কারণে বাড়তি সতর্কতা হিসেবে জীবনধারণের জন্য মৌলিক জিনিস ছাড়া মানুষ আর অন্য কিছু কিনছে না। এমনকি পোশাক-আশাকের মতো মৌলিক চাহিদাগুলো মানুষ এ সময়ে দমিয়ে রাখছে, যার প্রভাব পড়ছে বিক্রিতে। আমাদের প্রতি বছরের একটা নির্দিষ্ট সেল টার্গেট থাকে। এবার হয়তো বছর শেষে সেই টার্গেট পূরণ করা সম্ভব হবে না। বর্তমানে ব্যবসার সব খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা তার ব্যতিক্রম নই।

বাংলাদেশ রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ারকন্ডিশনিং মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য বলছে, এনলিস্টেড-ননএনলিস্টেড মিলিয়ে সারা দেশে ১০ হাজারে মতো ছোট-মাঝারি-বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও দোকান আছে। এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দোকানের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে ২০ হাজার মানুষ জড়িত। করোনায় সিংহভাগ দোকানেই অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। বেচাকেনা না হওয়ায় দোকান ভাড়া ও শ্রমিকদের বেতন দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। সংগঠনটির নেতারা বলছেন, করোনার কারণে দুই মাস একেবারে বেচাকেনা হয়নি। জুনের পর থেকে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশের মতো ব্যবসা হচ্ছে। তাই গত মার্চ থেকে যদি হিসাব করা হয়, তাহলে বলতে হয় আদতে ব্যবসা হয়েছে ১০ শতাংশ।

বিপুল পরিমাণ ইলেকট্রনিক পণ্য থেকে গেছে ব্যবসায়ীদের গুদামে। বিক্রি না থাকায় কর্মচারীদের বেতনও দিতে পারেননি দোকানি/ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, দেশের মানুষের মধ্যে চাহিদা থাকলে তবে তো ব্যবসা হবে। আর মানুষের তখনই চাহিদা তৈরি হবে, যখন তার হাতে পয়সা থাকবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে চাকরিচ্যুতি, বেতন কর্তন, ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা থাকায় আর্থিক টানাপড়েনের মধ্যে পড়েছে মানুষ, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ইলেকট্রনিকস ব্যবসায়।

বর্তমানে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে যাদের রেফ্রিজারেটর, এয়ারকন্ডিশনারের মতো পণ্য কেনার দরকার ছিল, তারা কিনছে না। যাদের এসব পণ্য মেরামতের দরকার ছিল, সেটাও করাচ্ছে না। মার্চ, এপ্রিল ও মে—এই তিন মাস এভাবেই চলেছে। এখন কিছুটা বেচাকেনা হলেও খাতটি টিকে থাকার জন্য তা যথেষ্ট নয়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনাকালে শরীর সুস্থ রাখতে এসির ব্যবহারও কমিয়ে দিয়েছে মানুষ। তাদের মতে, জিনিস নিয়মিত ব্যবহার হলে সেটা নষ্টও হবে। নানা ধরনের যন্ত্রাংশের প্রয়োজন হবে। মানুষ এসির ব্যবহার কমিয়ে দেয়ায় এসি মেরামত ও যন্ত্রাংশের বিক্রিও কমেছে।

সাপ্লাই চেইন ঠিক থাকলেও ক্ষতিগ্রস্ত আন্তর্জাতিক বাজার: করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত ইলেকট্রনিক পণ্যের সাপ্লাই চেইনটা ঠিক রেখেছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশের স্বল্পতা নেই। তবে প্রতিবেশী দেশগুলোতে একটা বাজার তৈরি করে ফেলেছিল বাংলাদেশী ইলেকট্রনিকস কোম্পানিগুলো। করোনাভাইরাসের প্রভাবে এসব বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

তবে এ সংকটেও কিছুটা আশার কথাও জানিয়েছেন ওয়ালটনের নির্বাহী পরিচালক উদয় হাকিম। তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোয় বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ইউরোপের কিছু উন্নত দেশে নতুন বাজার তৈরির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে জার্মানি থেকে কম্প্রেসর, ইতালি থেকে টেলিভিশনের অর্ডার পেয়েছে ওয়ালটন। এই দুই দেশসহ ইউরোপের উন্নত দেশগুলোয় বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক পণ্যের বড় বাজার দেখছেন তিনি।

বেড়েছে কিছু পণ্যের চাহিদা: ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই সময়ে বিলাস পণ্য মানুষ কিনতে চাইছে না। কারো ফ্রিজ-এসি কেনার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও আর্থিক সচেতনতা তৈরি হওয়ায় আপাতত তারা সেটা স্থগিত রাখছে। আবার করোনার এই সময়ে দোকান থেকে ফ্রিজ কিনে আনাটাকেও বেশি ঝক্কির কাজ হিসেবে দেখছে কেউ কেউ। বিপরীতে নতুন কিছু পণের চাহিদা তৈরি হয়েছে। লন্ড্রির ওপর ভরসা না করতে পারায় কাপড় ধোয়ার জন্য ওয়াশিং মেশিন কিনছে মানুষ। কিনছে আয়রন মেশিন। এখন মানুষ সেলুনেও যেতে চাইছে না। ফলে শেভার, ট্রিমারের মতো ছোটখাটো ইলেকট্রিক্যাল পণ্যের চাহিদাও বাড়ছে। বর্তমানে আউটলেটের চেয়ে অনলাইন ও ই-কমার্স সাইটগুলোর মাধ্যমে বেড়েছে ইলেকট্রনিক পণ্য বিক্রি।

সরকারি প্রণোদনা পর্যন্ত যেতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা: ব্যবসা-বাণিজ্য সচল করতে ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ দিচ্ছে সরকার। সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে সবগুলো ব্যাংকে এই টাকা দিয়েছে। ব্যাংকগুলো ৯ শতাংশ সুদে ব্যবসায়ীদের ঋণ দেবে। প্রণোদনা হিসেবে সুদের এই ৯ শতাংশের মধ্য সাড়ে ৪ শতাংশ শোধ করবে সরকার, বাকি সাড়ে ৪ শতাংশ সুদ বহন করতে হবে ঋণগ্রহীতাকে। ঋণের টাকা দেয়া এবং আদায় করা হবে ব্যাংকের নিয়মনীতির মাধ্যমে। ইলেকট্রনিক খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইকুইটির মর্টগেজ না দিলে ব্যাংক সেই ব্যবসায়ীকে ঋণ দেবে না। ব্যবসায়ীরা তিন মাস চলা করোনা পরিস্থিতিতে বিপুল পরিমাণ লোকসানে রয়েছেন। এমন অবস্থায় সিংহভাগ ব্যবসায়ীরই মর্টগেজ দেয়ার ক্ষমতা নেই। তাই হাতে গোনা দুয়েকজন ছাড়া কেউ সরকারি প্রণোদনা পর্যন্ত যেতে পারবে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ারকন্ডিশনিং মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মতিউর রহমান দেওয়ান। তিনি বলেন, দুয়েকজন ব্যবসায়ী ছাড়া সকরকারি প্রণোদনা কাজে লাগানোর সুযোগ ইলেকট্রনিক খাতের ব্যবসায়ীরা পাবেন না। সরকার বা ব্যাংকগুলো যদি ঋণ পাওয়ার শর্ত কিছুটা শিথিল করে তাহলে হয়তো প্রণোদনার অর্থ কাজে লাগতে পারে।

সূত্র :বণিক বার্তা

কোন মন্তব্য নেই