সাহেদের ইন্ধনদাতাদের তালাশে একাধিক সংস্থা - TIMES EXPRESS | টাইমস এক্সপ্রেস is an interactive news portal

নিউজ ফাস্ট

সাহেদের ইন্ধনদাতাদের তালাশে একাধিক সংস্থা














রিমান্ডে গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে মুখ খুলতে শুরু করেছেন প্রতারক মো. সাহেদ। কখনো পৃথক ভাবে এবং কখনো দুই সহযোগি পারভেজ ও শিবলীকে মুখোমুুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। জিজ্ঞাসাবাদে রিজেন্ট হাসপাতালের পেছনে কারা রয়েছে এবং কারা মদত দিয়ে কাজ পাইয়ে দিয়েছে তাদের নাম প্রকাশ করেছে সাহেদ। মদতদাতাদের তালাশ করতে মাঠে নেমেছে একাধিক সংস্থা। অন্যদিকে গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে সাহেদ জানিয়েছে, অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে পিপিই-মাস্ক ব্যবসাও করেছিল। প্রতারণা জায়েজ করতে ব্যবহার করতো কলগার্ডদের। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরের বড় কর্তাদের মনোরঞ্জন করতে এসব কলগার্লদের পাঠাতেন তিনি। এছাড়া তার মামলার তদন্তভার নিতে চায় র‌্যাব। এ জন্য অনুমতি চেয়ে র‌্যাবের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদনও করা হয়েছে। সাহেদের কার্যালয় থেকে উদ্ধারকৃত জাল টাকাগুলো মাসুদ পারভেজের সহযোগিতায় সংগ্রহ করে এবং বিপণনের উদ্দেশে সংরক্ষণ করা হয় বলে গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে তারা। এছাড়া নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে ভয়ঙ্কর প্রতারণা করেছে সাহেদ। তার মারধরের শিকার হয়েছেন অনেক নিরাপত্তাকর্মী। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, কাউকে ফাঁসাতে চেষ্টা করছে না প্রকৃত পক্ষে সাহেদের সাথে ওইসহ ব্যক্তির (যাদের নাম বলেছে) সর্ম্পক ছিল তার সত্যতা জানার চেষ্টা চলছে। গত বৃহস্পতিবার সাহেদকে ১০দিন, হাসপাতালের এমডি মাসুদ পারভেজকে ১০দিন এবং তার সহযোগি শিবলীকে ৭দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ডিবির কর্মকর্তারা।

অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে পিপিই-মাস্ক ব্যবসাঃ সাহেদ একটি প্রতিষ্ঠান খুলে সরকারিভাবে অনুমতি নিয়ে হাসপাতালের চিকিৎসকদের মাস্ক-পিপিই সরবরাহ করছিলেন। যদিও প্রতিষ্ঠানটির কোনো অস্তিত্ব নেই। গতকাল শনিবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে অনানুষ্ঠানিক এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার মো. আব্দুল বাতেন।

সাহেদকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ ও মামলার তদন্তের বিষয়ে তিনি বলেন, সাহেদ অ্যালফার্ড গেøাবাল ফ্যাক্টরি লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলে সরকারিভাবে অনুমতি নিয়ে হাসপাতালের চিকিৎসকদের মাস্ক-পিপিই সরবরাহ করতেন। অথচ প্রতিষ্ঠানটির কোনো অস্তিত্বই নেই। তিনি করোনাকালে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে একটি ফেসবুকে পেজ খুলেই পিপিই সরবরাহের সাব-কন্ট্রাক্ট নিয়ে পিপিই সরবরাহ করছিলেন। এছাড়া তার ঠিকাদারি ব্যবসা ও প্রতারণার বিষয়ে আমরা আরও তথ্য পেয়েছি। উত্তরাসহ কয়েকটি থানায় ৫টি মামলাও হয়েছে।

সাহেদকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে তিনি বলেন, সাহেদের নানাবিধ প্রতারণার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়াও তার ঠিকাদারি ব্যবসা ও প্রতারণার বিষয়ে আমরা আরও তথ্য পেয়েছি। এ বিষয়ে রাজধানীর উত্তরাসহ কয়েকটি থানায় ৫চটি মামলা হয়েছে বলেও জানান তিনি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে অস্তিত্বহীন একটি প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে পিপিই সরবরাহের অনুমতি দেয়া হলো, এমন প্রশ্নের জবাবে ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, কেন দিয়েছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন।







মামলার তদন্তভার নিতে চায় র‌্যাবঃ সাহেদের মামলার তদন্তভার নিতে চায় র‌্যাব। এ জন্য অনুমতি চেয়ে র‌্যাবের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদনও করা হয়েছে। আবেদনটি আজ রোববার মন্ত্রণালয়ে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত সাহেদের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করেছে র‌্যাব। তাই সাহেদের মামলার তদন্তভার নিতে চেয়ে গত বৃহস্পতিবার পুলিশ সদরদপ্তরের মাধ্যমে ওই আবেদন করা হয়।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, মামলা তদন্তের জন্য একটি আইনগত প্রক্রিয়া আছে। বিশেষ করে মামলা তদন্তের জন্য অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়। এই বাস্তবতায় মামলাটি তদন্তের জন্য পুলিশ সদরদপ্তরের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। সেটা সম্ভবত সদরদপ্তরে আছে। রোববার অফিস খুললে হয়ত সেটা মন্ত্রণালয়ে পৌঁছাবে। র‌্যাব জানিয়েছে, সাহেদের বিভিন্ন অনিয়ম ও প্রতারণার অভিযোগ প্রতিনিয়ত আসছে।

সুন্দরী ফাঁদ সাহেদেরঃ সাহেদের ৪ কলগার্ল। তার প্রতারণা জায়েজ করতে ব্যবহার করা হতো তাদের। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরের বড় কর্তাদের মনোরঞ্জন করতে এসব কলগার্লদের পাঠাতেন তিনি। তাতেও কর্মকর্তারা ম্যানেজ না হলে কলগার্লদের সঙ্গে তাদের থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে পাঠাতেন। তাদের সব খরচ বহন করতেন সাহেদ। বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে টেন্ডার, তদবির এবং বিভিন্ন কাজের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে নিতেন। সেই ৪ কলগার্লের নাম ও ঠিকানা এখন গোয়েন্দাদের হাতে। সাহেদ র‌্যাবের জালে আসার পরই তারা আত্মগোপনে চলে যায়। তার মধ্যে একজনকে সাময়িক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রিজন্টে হাসপাতালের একজন কর্মকর্তা জানান, হাসপাতালে সাহেদের অফিসে একাধিক নারীর যাতায়াত ছিল। অনেক নারী তার খপ্পড়ে পড়ে সব হারিয়েছেন। কেউ অর্থের কারণে ব্যবহার হয়েছিলেন।







বিপণনের জন্য জাল টাকা সংগ্রহঃ গত বুধবার র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে নিয়ে ওইদিনই রাজধানীর উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের তার একটি ফ্লাটে অভিযান চালায় র‌্যাব। সেখান থেকে ২৯২টি ৫০০ টাকার জাল নোট উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত জাল টাকাগুলো সাহেদ বিপণনের উদ্দেশে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেছেন। এ টাকাগুলো সংগ্রহের জন্য তাকে সহযোগিতা করেছেন রিজেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসুদ পারভেজ। জাল টাকা উদ্ধারের ঘটনায় ওই দিনই উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা করেন র‌্যাব-১ এর কর্মকর্তা মজিবুর রহমান। মামলার এজহারে এসব কথা উল্লেখ করেন মামলার বাদী। মামলার এজহারে আরো বলা হয়, জাল নোট সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সাহেদ স্বীকার করে যে, এ লাগেজ এবং লাগেজের ভেতরের মালামালগুলো তার নিজের এবং উদ্ধারকৃত জাল টাকাগুলো সে মাসুদ পারভেজের সহযোগিতায় সংগ্রহ করে এবং বিপণনের উদ্দেশে সংরক্ষণ করে। সাহেদ আরও স্বীকার করেন, মাসুদ পারভেজের সহযোগিতায় এবং বাড়ির মালিক ইয়াহিয়া খানের সহায়তায় চলতি মাসে ৩০ হাজার টাকা ভাড়া এবং পাঁচ হাজার টাকা সার্ভিস চার্জ প্রদানের মৌখিক চুক্তির ভিত্তিতে বাসাটি ভাড়া নিয়ে অফিস হিসেবে ব্যবহার করছিলেন। অফিসের নিয়ন্ত্রণ ও মালামাল সংরক্ষণ তাদের নিজের কাছে ছিল।







নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে সাহেদের ভয়ঙ্কর প্রতারণাঃএক নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে ভয়ঙ্কর প্রতারণা করেছেন সাহেদ। সাহেদের মারধরের শিকার হয়ে এক নিরাপত্তাকর্মী প্রায় পঙ্গু জীবনযাপন করছেন। করেছেন কারাভোগ এবং হারিয়েছেন বেঁচে থাকার সম্বল বাপ-দাদার জমি। ওই নিরাপত্তাকর্মীর নাম মো. জাহিদ (৪৭)। বাড়ি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায়। বাবা রহমত উল্লাহ। সিলেট সিটি করপোরেশনে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করতেন জাহিদ। মেয়র বদরউদ্দিন আহমেদ কামরানের দফতরেই তিনি ডিউটি করতেন। ২০০৪ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সিলেট সিটি করপোরেশনে চাকরি করেন জাহিদ। ২০০৭ সালে তত্তব্বধায়ক সরকারের আমলে মামলা হয় মেয়রের বিরুদ্ধে। তখন সাহেদ মেয়রের সঙ্গে দেখা করতে সিলেট গিয়েছিল। ওই সময় সাহেদের সঙ্গে জাহিদের পরিচয়।

গত শুক্রবার জাহিদ দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, তিনি (সাহেদ) আমাকে একটা ভিজিটিং কার্ড দিলেন। তখন তাকে দেখে ভদ্রলোকের মতো লাগছিল। তিনি আমাকে বলেছিলেন, চাকরি লাগলে যেন তাকে ফোন দেই। ২০১৭ সালের প্রথম দিকে সাহেদের দেয়া ভিজিটিং কার্ডে থাকা মোবাইল নম্বরে ফোন দেয় জাহিদ। ফোন দিয়ে জাহিদ চাকরি চায় সাহেদের কাছে। জাহিদ ওই বছরের জানুয়ারির শেষের দিকে কুলাউড়া থেকে ঢাকায় আসে। সাহেদের সঙ্গে দেখা করে। সাহেদ তাকে বলে, তুমি প্রধান নিরাপত্তাকর্মী, তোমার বেতন ২৫ হাজার টাকা। তুমি ভালো বেতন পাবা। আমাকে জামানত দিতে হবে। এক লাখ টাকা জামানত দিবা। তাহলে তোমার চাকরি কনফার্ম। বাড়িতে গিয়ে ৫ শতাংশ জমি আড়াই লাখ টাকায় বিক্রি করেন জাহিদ। এক লাখ টাকা নিয়ে ঢাকায় আসেন। পুরো টাকা তিনি সাহেদের কাছে জমা দেন। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে রিজেন্ট হাসপাতালের মিরপুর শাখায় জাহিদ প্রধান নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করে। সাহেদ স্টাফদের কাউকে কাউকে মারধর করে। এক পর্যায়ে জাহিদ ওই হাসপাতালের ম্যানেজারকে বলেন, আমি চাকরি করবো না, আমার জামানত ফেরত দিন। সাহেদ তখন জাহিদকে লিখিত অব্যাহতিপত্র দিতে বলে। জাহিদ তাই করেন। চাকরি ছেড়ে দিয়ে বেতন ও জামানতের টাকার জন্য ঢাকায় থাকে জাহিদ।







জাহিদ আরো বলেন, ১৩ মার্চ আমি বেতন ও জামানত আনার জন্য রিজেন্ট হাসপাতালে যাই। তখন আমাকে হাসপাতালের ম্যানেজার ও দুজন ব্যক্তি সাহেদের কক্ষে নিয়ে আটকে রাখে। কিছুক্ষণ পর সাহেদ আসে। সে এসেই আমার পিঠে ও কোমরে মেডিক্যালের হাতুড়ি দিয়ে পেটাতে থাকে। আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। এরপর পল্লবী থানায় খবর দেয় সাহেদ। পুলিশ এসে আমাকে নিয়ে যায়। পরে শুনি আমাকে চুরির মামলা দিয়েছে। আমি পুলিশকে এত বললাম, কেউ আমার কথা শুনলো না। থানায় নেয়ার পর পুলিশ আমাকে আবার মারলো। ১৫ দিন পর কারাগার থেকে আবার আমাকে আদালতে নিয়ে এলো পুলিশ। আমাকে কাঠগড়ায় তুললো। আমি হাঁটতে পারছিলাম না। কারণ, সাহেদ আমাকে মেরে কোমর ফাটিয়ে দিয়েছিল। তাই কাঠগড়ায় বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। সেখানে আমি কাঁদছিলাম। আমার কান্না দেখে একজন মুহুরি বিস্তারিত জানতে চাইলো, আমি তাকে বিস্তারিত বললাম। তিনি একটা ওকালতনামা আনলেন, আমি তাতে স্বাক্ষর করলাম। ঠিকানা বললাম। কিন্তু বাড়িতে কারও মোবাইল ছিল না। তাই খবর দিতে পারিনি। আমাকে আবার জেলখানায় নিয়ে গেলো। মুহুরি আমাকে বললো সে জামিন করানোর চেষ্টা করবে। ঘটনার দুই মাস পর আবার মামলার তারিখ আসে। জাহিদকে কারাগার থেকে আদালতে নিয়ে আসে পুলিশ। তার জামিন হয়। এরপর বাড়ি ফিরেন তিনি। তিনি বলেন, ২০১৮ সালের শুরুর দিকে জাহিদের আইনজীবী সবকিছু ঢাকার সিএমএম’র সংশ্লিষ্ট আদালতে খুলে বলেন। বিচারক জাহিদকে খাস কামরায় নিয়ে পুরো বক্তব্য রেকর্ড করেন। এরপর জাহিদ মামলা থেকে অব্যাহতি পান। সাহেদ গ্রেফতারের পর গত ১৫ জুলাই র‌্যাব সদরদফতরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। জাহিদ এখন অপেক্ষায় আছে টাকা ফেরত পাওয়া এবং বিচারের আশায়।

কোন মন্তব্য নেই