পাঠাচ্ছি সেরা আম, কাস্টমার পাচ্ছেন জুস - TIMES EXPRESS | টাইমস এক্সপ্রেস is an interactive news portal

নিউজ ফাস্ট

পাঠাচ্ছি সেরা আম, কাস্টমার পাচ্ছেন জুস

 

চাঁপাইনবাবগঞ্জে এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ফালো ফলন হয়েছে আমের। এখন চলছে আমের মৌসুম। চারদিকে কেবল রসালো আম আর আম। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে জেলার আম যাচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। অন্যদিকে করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশব্যাপী চলছে লকডাউন।

তাই আম পরিবহন ও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আম পাঠাতে এখন অন্যতম প্রধানমাধ্যম হয়ে উঠেছে কুরিয়ার সার্ভিস। কিন্তু উচ্চ ভাড়ায় কুরিয়ার সার্ভিসে আম পাঠিয়েও স্বস্তিতে নেই আমচাষি, ব্যবসায়ী, রফতানিকারকরা। কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর দায়িত্বহীনতা ও গাফিলতিতে পথেই পচে নষ্ট হচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে পাঠানো গ্রাহকের আম।

আমচাষি থেকে ব্যবসায়ীরা সরাসরি বাগানে আম সংগ্রহ করে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠাচ্ছেন। এছাড়া স্থানীয়রাও আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে আম পাঠাতে আশ্রয় নিচ্ছেন কুরিয়ার সার্ভিসের।
কিন্তু আম সঠিক সময়ে না পৌঁছানো, যত্নের অভাব, কর্মীদের অসদাচারণসহ এসব কুরিয়ার সার্ভিসের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের অভিযোগ বিস্তর। আম ডেলিভারি দিতে দেরি করায় পচে নষ্ট হয়ে হচ্ছে। এতে অসংখ্য অভিযোগ করছেন গ্রাহকরা। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজেদের নানা অভিযোগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন আমচাষি, ব্যবসায়ী ও গ্রাহকরা।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে কুরিয়ার সার্ভিসে প্রতিদিন গড়ে আনুমানিক ২০০-২৫০ টন আম যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। জেলা শহরে জেলা কার্যালয় ছাড়াও ৫ উপজেলা, ইউনিয়ন, বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে ও আমের বাজারগুলোতে উপশাখা না এজেন্ট বসিয়ে আম সংগ্রহ করছে কুরিয়ার সার্ভিসগুলো।



সুন্দরবন, এজেআর, করতোয়া, আহমেদ, জননী, ওমেক্স, এসএ পরিবহন, এসআরসহ আরও কিছু কুরিয়ার সার্ভিসে আম যাচ্ছে। উচ্চ ভাড়া হওয়া সত্ত্বেও সেবা নিয়ে গ্রাহকদের সবচেয়ে বেশি অভিযোগ সুন্দরবন, জননী ও করতোয়া কুরিয়ার সার্ভিসের বিরুদ্ধে। 

আম ব্যবসায়ী মো. নাসিম উদ্দিন বলেন, আমরা কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর কাছে জিম্মি কেন থাকব? আমরা যারা অনলাইন বিজনেস করি প্রিমিয়ার কোয়ালিটি আম বুকিং দিচ্ছি, কিন্তু বুকিংয়ের ৫-৬ দিন পর আম যাচ্ছে। পাঠাচ্ছি সেরা আম, কিন্তু কাস্টমার পাচ্ছে আমের জুস! এছাড়াও ক্যারেট কেটে আম বের করে নেওয়া, হারিয়ে যাওয়াসহ নানা অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে।

তিনি আরও বলেন, কুরিয়ারের লোকজন মনে করে বুকিং হয়ে গেলেই তাদের দায়িত্ব শেষ। আমার মতো যারা ক্ষুদ্র পরিসরে অনলাইনে আমের ব্যবসা করছে তারা ক্ষতির মুখে পড়ছে। অপরদিকে, কাস্টমাররা চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। যে আম চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যকে ধরে আছে, সেটা টিকিয়ে রাখা আমাদের সবার দায়িত্ব। প্রশাসন এ বিষয়ে নজর দিলে সমাধান হবে। 

সদর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গার সাদিকুল ইসলামের ছোট ছেলে নৌবাহিনীতে চাকুরির সুবাদে থাকেন বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। তিনি জানান, সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ছেলেকে ৩০ কেজি ফজলি আম পাঠিয়েছি ২ জুলাই। এক দিন পরে পাওয়ার কথা থাকলেও ছেলে আম পেয়েছে ৮ তারিখে। বাসায় আম নিয়ে গিয়ে দেখে ছেলে জানিয়েছে, ৩০ কেজি আমের প্রায় ৯০ ভাগ আম পচে গেছে। যা খাওয়ার অনুপযোগী। 

কলেজছাত্র সাকিবের বাবা থাকনে রাজধানী ঢাকার কাকরাইলে। জননী কুরিয়ার সার্ভিসের চাঁপাইনবাবগঞ্জ শাখায় ১৫ কেজি আম বুকিং দিয়ে ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও সেই আমের কোনো হদিস মেলেনি। সাকিব জানায়, এ নিয়ে অভিযোগ করতে গেলেও তারা আম ডেলিভারি হয়ে গেছে বলে কোনো আমলে নেয়নি। উল্টো কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মীরা অসদাচরণ করেন সাকিবের সঙ্গে। 

অনলাইনে আমের ব্যবসা নিয়ে ২০১৯ সাল থেকে কাজ করছেন আবুল হাসনাত পরশ। তিনি বলেন, আমরা যারা অনলাইনে অর্ডার নিয়ে গ্রাহকের কাছে আম পাঠাই তাদের কাছে কুরিয়ার সার্ভিসের সহায়তা নিতে হয়। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর অনেক বেশি কুরিয়ারের ওপর নির্ভরশীল অনলাইন আম উদ্যোক্তারা।

তিনি আরও বলেন, অথচ কুরিয়ারে আম বুকিং দিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ভোগান্তির শিকার হই। শুরুতে আম পৌঁছাতে এক-দুদিন সময় লাগলেও এখন আম পৌঁছাতে ৩-৫ দিন লেগে যাচ্ছে। আমগাড়ি লোডিংয়ের সময় অযত্নে আম চালিয়ে ফেলায় আম নষ্ট হয়েছে।

আঘাত পেয়ে আমের দাগ লাগা ও পচে যাওয়ার জন্য কুরিয়ার সার্ভিসের অযত্ন ও অবহেলাকে দায়ী করে তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে গ্রাহকের কাছে কম আম পৌঁছানোর অভিযোগ পেয়েছি। আম শুকালে ওজন কমে যায়। তাই ২২ কেজির একটা অর্ডারে ২৪ কেজি আম দিয়েছিলাম, তবে ক্রেতা জানায়, আমের ওজন ১৬ কেজি। কম সময়ে আম না পৌঁছাতে পেরে এবং আম চুরি যাওয়ার ঘটনায় আমরা বিব্রত।

বৃহস্পতিবার (০৮ জুলাই) সকাল ১১টা। জেলা শহরের আ.হ.ম. মেসবাহুল হক বাচ্চু ডাক্তার স্টেডিয়ামের আমের বাজারে দেখা গেল জটলা বেঁধেছে মানুষ। সেখানে থাকা ওমেক্স কুরিয়ার সার্ভিসের সামনে উচ্চবাক্য করছেন কুরিয়ারের কর্মী ও একজন গ্রাহক।
পরে জানা গেল, এক আত্মীয়ের জন্য আম কিনে এখানেই বুকিং দিয়েছিলেন এক গার্মেন্টস ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম। ৪ দিন হয়ে গেলেও আম না পৌঁছার কারণে কথা কাটাকাটি করছেন তিনি।



একটি পরিবহন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মো. বখতিয়ার খলজি। তিনি বলেন, ৭ তারিখে আম পাঠিয়ে ডেলিভারি হয়েছে ১২ তারিখে। সবগুলো আম পচে নষ্ট হয়েছে। এর চেয়ে বড় অনিয়ম, আম পাঠিয়েছি ৫০ কেজি, কিন্তু ভাউচারে লিখেছে ৩৫ কেজি!

কুরিয়ার সার্ভিসের বিভিন্ন অব্যবস্থাপনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আজিজুর রহমান আজিজ লিখেছেন, সদর উপজেলার রানিহাটি থেকে ওমেক্স কুরিয়ারে আম পাঠানোর চারদিন পর ঢাকায় পৌঁছায়। সব আম পচে গেছে।

মুনির এইচ মোল্লা জানান, সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ২৩ কেজি করে দুটি ক্যারেট পাঠিয়েছিলাম ঢাকায়। দুটির মধ্যে একটি পেয়েছে, তাও আবার ১৮ কেজি। বাকি ৫ কেজি আম ও আরেকটি ক্যারেট হারিয়ে গেছে। সেবার মান বিবেচনায় এসব কুরিয়ার সার্ভিস বন্ধের দাবি লিটিল বিশ্বাসের। জননী কুরিয়ারে তিন দিন হয়ে গেলেও মহাখালীতে আম পায়নি বলে তার অভিযোগ। 

কুরিয়ার সার্ভিসে আম পাঠাতে গিয়ে অদ্ভুত ও ভিন্ন অভিজ্ঞতাও হয়েছে গ্রাহকদের। ফেসবুকে সাইফুল ইসলাম লিখেছেন, আম পাঠালাম চিটাগাং রোডে, পৌঁছলো নারায়ণগঞ্জে। পাঠিয়েছি দুই কার্টনে ৪০ কেজি, পেয়েছে ২০ কেজি। আহমেদ কুরিয়ার সার্ভিসে ৪ দিন হয়ে গেলেও আম ডেলিভারি না হওয়ায় আবু জাফর বলছেন, আম পেঁকে আঁটি থেকে গাছ হওয়ার পর ডেলিভারি হতে পারে!

প্রতিযোগিতামূলক যুগে আমরা গ্রাহকদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। তারপরেও কিছু সমস্যা রয়েছে। তবে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অভিযোগ করলে তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে।
মো. সাইদ, ম্যানেজার, সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
জননী কুরিয়ার সার্ভিস কানসাট শাখার ব্যবস্থাপক সোহাগ আলী বলেন, মৌসুমে প্রচুর পরিমাণ আম বুকিং হয়। গ্রাহকদের ভালো সেবা দেয়ার চেষ্টা করছি। তারপরেও যদি দুই-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে সেজন্য আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. জহিরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানান, জেলার বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিসের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। হাতেগোনা কিছু ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। শুনানি করে অভিযোগকারীদের সমাধান দেওয়া হয়েছে।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. জাকিউল ইসলাম বলেন, এ নিয়ে আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। জেলার আম ব্যবসায়ের স্বার্থে অভিযুক্ত কুরিয়ার সার্ভিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

কোন মন্তব্য নেই