খাদ্যে উদ্বৃত্ত জেলাগুলোতেই খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার হার সবচেয়ে বেশি
শিল্পের অগ্রগতি মন্থর হওয়ার কারণে এ জেলার মানুষের কৃষিনির্ভরতা তুলনামূলক বেশি। জেলাটির মোট আয়তনের ৮০ ভাগ জমিতে আবাদ হয় বিভিন্ন ধরনের ফসল। বেশির ভাগ পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস কৃষি। আবার কৃষকদের অধিকাংশই প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও ভূমিহীন। বর্তমানে চাহিদার চেয়ে দ্বিগুণের বেশি চাল উৎপাদন হয় এ জেলায়। উদ্বৃত্ত থাকে অন্যান্য ফসলও। অন্য জেলার মানুষের চাহিদা পূরণ করে এখানকার উদ্বৃত্ত ফসল। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও কৃষির বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি দিনাজপুরে। বড় ধরনের শিল্প-কারখানাও গড়ে ওঠেনি। ফলে জেলার প্রায় ৬৪ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যহারের উচ্চরেখায় অবস্থান করছে। আবার এ জেলার প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ বছরের একটি নির্ধারিত সময়ে মধ্যম ও গুরুতর দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভোগে।
শুধু দিনাজপুর জেলাই নয়, খাদ্যে উদ্বৃত্ত থাকা জেলাগুলোর মধ্যে বেশির ভাগেরই দারিদ্র্যের হার বেশি, ভোগে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায়ও। অন্যদিকে শিল্পায়ন ও বিকল্প কর্মসংস্থান থাকায় খাদ্য ঘাটতিতে থাকা জেলাগুলো দরিদ্রতা ও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার দিক থেকে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি), বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও আইপিসির জেলাভিত্তিক তথ্য পর্যালোচনায় এমন চিত্রই উঠে এসেছে। মূলত খাদ্যোৎপাদনে এগিয়ে থাকা জেলাগুলোয় শিল্পায়ন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের অভাবের কারণে দারিদ্র্য পিছু ছাড়ছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ব্রির এক গবেষণা প্রতিবেদনে চাল উৎপাদনে দেশের জেলাগুলোর ২০১৪-১৫ অর্থবছরের উদ্বৃত্ত ও ঘাটতি নিয়ে জেলাভিত্তিক তথ্যের মানচিত্র প্রকাশ করা হয়। এ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ব্রির বর্তমান মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর। মানচিত্রে দেখানো খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকা জেলাগুলোয় তুলনামূলকভাবে জনসংখ্যা বৃৃদ্ধির সমান্তরালে খাদ্যোৎপাদনও বেড়েছে। ফলে বর্তমানেও চাল উদ্বৃত্তের চিত্র অনেকটা একই রকম। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, দিনাজপুর জেলায় ২০১১ সালে জনসংখ্যা ছিল ২৯ লাখ ৯০ হাজার ১২৮। ২০২১ সালে এসে জনংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৩ লাখ ১৫ হাজার ২৩৮। অর্থাৎ ১০ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে ৩ লাখ ২৫ হাজার ১১০। জেলাটিতে বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার মাত্র ১ শতাংশ। অন্যদিকে জেলাটিতে ২০১০-১১ অর্থবছরে চাল উৎপাদন হয়েছে ১৩ লাখ ১৪ হাজার ১৮৯ টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৩২ হাজার ৪২৬ টনে। অর্থাৎ চাল উৎপাদনও প্রায় ১ শতাংশ হারে বেড়েছে।
গবেষকরাও একই কথা বলছেন। ব্রির মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতে খাদ্য মানচিত্রে বড় রকমের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং কোনো কোনো জেলায় খাদ্য উদ্বৃত্ত বেড়েছে।
ব্রি থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে চাল উদ্বৃত্ত থাকা জেলাগুলোর শীর্ষে রয়েছে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, ঝিনাইদহ, জয়পুরহাট, শেরপুর, নওগাঁ, বগুড়া, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও ভোলা। এসব জেলায় ৮০ থেকে ১৮৩ শতাংশ পর্যন্ত চাল উদ্বৃত্ত থাকে। কুড়িগ্রাম, জামালপুর, নীলফামারী, রংপুর, মাগুরা, যশোর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ ও পটুয়াখালী জেলায় ৫১ থেকে ৭৭ শতাংশ চাল উদ্বৃত্ত থাকে। গাইবান্ধা, নাটোর, টাঙ্গাইল, মৌলভীবাজার, ময়মনসিংহ, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও চুয়াডাঙ্গা জেলায় ২২ থেকে ৪৮ শতাংশ চাল উদ্বৃত্ত থাকে। রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, নোয়াখালী ও বান্দরবান জেলায় ১ থেকে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত চাল উদ্বৃত্ত থাকে। অর্থাৎ এ জেলাগুলোয় খাদ্যশস্যের ঘাটতি নেই।
তবে খাদ্যশস্য উদ্বৃত্ত থাকলেও এসব জেলাগুলোতেই দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি। বিবিএসের ‘বাংলাদেশের দারিদ্র্য মানচিত্র’ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের দারিদ্র্যপীড়িত জেলাগুলোর শীর্ষে রয়েছে কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, জামালপুর, মাগুরা, কিশোরগঞ্জ, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। এসব জেলায় ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যহারের উচ্চরেখায় অবস্থান করছে। শুধু খাগড়াছড়ি জেলা ব্যতীত অন্য সব জেলায়ই খাদ্যশস্য উৎপাদন চাহিদার চেয়ে বেশি। কুড়িগ্রাম জেলায় ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ, দিনাজপুরে ৬৪ দশমিক ৩, জামালপুরে ৫২ দশমিক ৫, মাগুরায় ৫৬ দশমিক ৭, কিশোরগঞ্জে ৫৩ দশমিক ৫, খাগড়াছড়িতে ৫২ দশমিক ৭ ও বান্দরবানে ৬৩ দশমিক ২ শতাংশ দারিদ্র্যহারের উচ্চরেখায় অবস্থান করছে।
ভিন্ন চিত্র খাদ্য ঘাটতিতে থাকা জেলাগুলোয়। চালের ঘাটতিতে থাকা জেলাগুলোর শীর্ষে রয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও রাঙ্গামাটি। এ জেলাগুলোয় ৪৬ থেকে ৯১ শতাংশ পর্যন্ত চালের ঘাটতি রয়েছে। আর মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, চাঁদপুর ও মাদারীপুরে ১৯-৪০ শতাংশ চালের ঘাটতি রয়েছে। তবে এসব জেলা দারিদ্র্যের দিক থেকে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে রয়েছে। দারিদ্র্যহারের উচ্চরেখায় অবস্থান করছে ঢাকায় ১০ শতাংশ, চট্টগ্রামে ১৩ দশমিক ৭, গাজীপুরে ৬ দশমিক ৯, নারায়ণগঞ্জে ২ দশমিক ৬, মুন্সিগঞ্জে ৩ দশমিক ১, মানিকগঞ্জে ৩০ দশমিক ৭, নরসিংদীতে ১০ দশমিক ৫, ফরিদপুরে ৭ দশমিক ৭, রাজবাড়ীতে ৩৩ দশমিক ৮, শরীয়তপুরে ১৫ দশমিক ৭, চাঁদপুরে ২৯ দশমিক ৩ ও মাদারীপুরে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ।
বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশন (আইপিসি)। ২০০৯-১৯ সাল পর্যন্ত ১০ বছর সময় নিয়ে দেশের সব জেলার খাদ্যনিরাপত্তার চিত্র বিশ্লেষণ করেছে সংস্থাটি। আইপিসির পরিসংখ্যানেও খাদ্যে উদ্বৃত্ত জেলাগুলোয় খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় বেশি মানুষ ভুগছে। প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের কুড়িগ্রাম, সুনামগঞ্জ, গাইবান্ধা, বান্দরবান, কক্সবাজার ও জামালপুর—ছয় জেলার ৩৫-৪০ শতাংশ মানুষ মধ্যম ও গুরুতর দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। যদিও এর মধ্যে কক্সবাজার ছাড়া বাকি সব জেলায়ই খাদ্যশস্য উদ্বৃত্ত থাকে। এছাড়া বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, খাগড়াছড়ি, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর, নেত্রকোনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, লালমনিরহাট, দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলার ৩০ শতাংশ মানুষ মধ্যম ও গুরুতর দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
মূলত কৃষিনির্ভর জেলাগুলোয় বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় মানুষের মধ্যে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা ও দরিদ্রতা দেখা দিচ্ছে। দিনাজপুর জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলাটিতে বছরে ২ লাখ ৭৫ হাজার হেক্টর জমিতে আমন ও ১ লাখ ৭৮ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ হয়েছে। উৎপাদিত ধান থেকে প্রতি বছর প্রায় ১৬ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়। এর মধ্যে জেলার মানুষের চাহিদা পূরণ, বীজ ও অন্যান্য ব্যবহার বাবদ প্রায় আট লাখ টন চাল প্রয়োজন হয়। বাকি আট লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকে। অর্থাৎ উৎপাদিত অর্ধেক চাল চলে যায় দেশের অন্যান্য জেলায়। চাল ছাড়াও আলু, গম, ভুট্টা এবং বিভিন্ন সবজি ও ফল যে পরিমাণে উৎপাদন হয় তা জেলার চাহিদা মিটিয়ে একটা বড় অংশ দেশের অন্যান্য জেলার চাহিদা পূরণ করে। খাদ্যে উদ্বৃত্ত হলেও জেলাটিতে দারিদ্র্যের হার প্রায় ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. নুরুজ্জামান বলেন, ‘কেবল কৃষিতে ভর করে খেয়েপরে বেঁচে থাকা যায়। না খেয়ে মানুষ মরে না, কিন্তু তা দিয়ে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি সম্ভব নয়। দারিদ্র্যসীমার ওপরেও ওঠা যায় না। দিনাজপুরে মানুষের বিকল্প আয় বা কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। উত্তরাঞ্চলের কৃষিপ্রধান জেলাগুলোর মানুষের কৃষি ছাড়া বিকল্প কোনো কর্মসংস্থান না থাকার কারণে মানুষ দারিদ্র্যসীমার সবচেয়ে নিচে বাস করছে। আমি দিনাজপুরে চাকরি করি, কিন্তু নিজের জেলা কুড়িগ্রাম। কুড়িগ্রাম জেলাও খাদ্যে উদ্বৃত্ত জেলা। কিন্তু মাথাপিছু আয় সর্বনিম্ন।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি দিনাজপুর জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি আলতাফ হোসাইন বলেন, খাদ্যে উদ্বৃত্ত জেলা হলেও এক কৃষি খাত দিয়ে তো আর বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সম্ভব নয়। শিল্প বিকাশের দিক থেকে দিনাজপুর সবচেয়ে পশ্চাত্পদ জেলা। বেকারত্বের হার বেড়েই চলেছে। মাথাপিছু আয় কমে যাচ্ছে। দিন দিন মানুষ ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। এভাবে মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক খালেদ মোহাম্মদ জাকীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘দিনাজপুরের দারিদ্র্যহারের বিষয়টি সম্পর্কে আমার জানা নেই। জেনে জানাতে হবে।’
একই চিত্র সুনামগঞ্জ জেলায়। এ জেলায়ও চাল উদ্বৃত্ত থাকে প্রায় চার লাখ টন। এছাড়া অন্যান্য খাদ্যশস্য চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন হয়। তবে কৃষির বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ বা সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ গুরুতর দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এসব মানুষ বছরের চার মাস বা তার বেশি সময় একবেলা খাবার সংকটে ভুগছে। আর ১৫ শতাংশ বা চার লাখের বেশি মানুষ মধ্যম দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তারা বছরের দুই-চার মাস খাবারের অভাবে থাকে। তবে জেলার ৩৫ শতাংশ বাসিন্দা বা পৌনে ১০ লাখ মানুষ মৃদু দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। বাকি ৩০ শতাংশ বা ৮ লাখ ৩০ হাজার মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা ঠিক রয়েছে। এছাড়া জেলাটিতে দারিদ্র্যহারের উচ্চরেখায় অবস্থান করছে ২৬ শতাংশ মানুষ।
জেলাটির হাওরের কৃষক গোলাম সারোয়ার লিটন বলেন, হাওরের মানুষ এক ফসলি জমির বোরো ধানের ওপর নির্ভরশীল। বোরো ধান ভালো হলে সব কৃষকের ভাতের জোগান দেয়। পাশাপাশি তাদের সংসারের খরচ বহন করে। কিন্তু মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ কম। সুযোগ না থাকায় হাওর অঞ্চলে দারিদ্র্যের হার বেশি।
হাওর এরিয়া আপলিস্টমেন্ট সোসাইটি-হাউজের নির্বাহী পরিচালক সালেহীন চৌধুরী শুভ বলেন, সুনামগঞ্জের গ্রামগঞ্জ ও হাওরপাড়ের মানুষ গরিব, অসহায়, দিনমজুর হওয়ায় দারিদ্র্য পিছু ছাড়ে না। বছরের অনেক সময় কর্মহীন থাকে তারা। হাওরাঞ্চলের মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় অভাব-অনটনে দিন কাটে তাদের। বছরের একমাত্র ফসল বোরো ধান গোলায় তোলার আগেই ঋণগ্রস্ত মানুষ ঋণ পরিশোধ করতে ধান-চাল বিক্রি করায় বছর শেষে তাদের খাদ্যের সংকট থেকেই যায়, যার কারণে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা ও দরিদ্রতা দূর হয় না।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, ‘হাওর অঞ্চলের মানুষ খাদ্যশস্য মজুদ না করার কারণে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভোগে বলে মনে করি।’
সার্বিক বিষয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. রিপন কুমার মণ্ডল বলেন, উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয় ভূমি মালিকরা একসঙ্গে অনেক ভূমির মালিক। আবার যারা চাষে জড়িত তাদের অধিকাংশই বর্গাচাষী অর্থাৎ প্রান্তিক খামারি। ফলে অর্ধেক ফসল মালিককে দিতে হয়। এতে দারিদ্র্যের হার বেড়ে যায়। আবার যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা না থাকায় এসব অঞ্চলে ভালো শিল্পও গড়ে উঠছে না। শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। সরকারকে এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
সাবেক খাদ্য সচিব মো. আবদুল লতিফ মণ্ডল বলেন, খাদ্যোৎপাদনই দারিদ্র্যের একমাত্র নির্ধারক নয়। দরিদ্রতার বহুমাত্রিক কারণ রয়েছে। শিল্পায়ন, শিক্ষা, বিকল্প কর্মসংস্থান, যোগাযোগসহ আরো অনেক ইন্ডিকেটর রয়েছে। যেসব জেলা খাদ্যোৎপাদনে এগিয়ে, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয় ভালো কোনো ইন্ডাস্ট্রি গড়ে ওঠেনি। ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট জেলা খাদ্যোৎপাদনে পিছিয়ে। কিন্তু তাদের শিল্পায়ন, প্রাকৃতিক সম্পদ ও বিভিন্ন ধরনের আয়ের উৎস থাকায় এ জেলাগুলোর মানুষ ধনী।
কৃষিনির্ভরশীল জেলাগুলোয় কৃষিসংশ্লিষ্ট শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এসব জেলায় উচ্চহারে শিল্পায়নে গুরুত্ব দিতে হবে। যেমন রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলে ভালো আম-লিচু হয়। এসব এলাকায় এ-জাতীয় শিল্প গড়ে তোলা যেতে পারে। অর্থাৎ সারা দেশেই প্রাধান্যের ভিত্তিতে কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলায় জোর দিতে হবে। অন্যান্য দেশের চেয়ে আমাদের দেশে জমি অনুপাতে উৎপাদনশীলতা অনেক কম। ফলে কৃষক বিনিয়োগ অনুপাতে লাভ করতে পারেন না। এছাড়া কৃষিতে শ্রম অপচয় হয়। যেমন এক টুকরো জমিতে দেখা গেছে দুজন দক্ষ শ্রমিক শ্রম দিলে হচ্ছে। কিন্তু সেখানে পরিবারের চার-পাঁচজন শ্রম দিচ্ছে। ফলে বাড়তি শ্রম যাচ্ছে। এটা অনেকটা ছদ্মবেশী বেকারত্ব তৈরি করছে। বৃহৎ শিল্প-কারখানা না থাকায় এসব অঞ্চলে বেকারত্বের হার ও দারিদ্র্যের হার বেড়েই চলেছে। বহুমাত্রিক আয়ের উৎস তৈরি করতে হবে।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘কৃষিনির্ভর জেলাগুলোয় ভূমির মালিকানায় বৈষম্য রয়েছে। এসব অঞ্চলে ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা বেশি। শুধু উৎপাদন থাকলেই হবে না। মানুষের আয় থাকতে হবে। খাদ্যোৎপাদন বেশি হলেও ভূমিহীনতার কারণে এর সুফলের সমান ভাগীদার সবাই হচ্ছে না। পাশাপাশি বিকল্প কর্মসংস্থান ও শিল্পায়নের অভাব তো রয়েছেই। এসব বিষয়ে জোর দিতে হবে। আমাদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে প্রবৃদ্ধি কৌশলে নজর কম। কর্মসংস্থানভিত্তিক কর্মসংস্থানের কৌশলে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের সামনে এগোতে হবে।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের বর্তমান লক্ষ্য কৃষিকে লাভজনক ও বাণিজ্যিকীকরণ করা। প্রক্রিয়াকরণ ও কৃষিভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান তৈরি করা, এটা নির্দশনার মধ্যেই রয়েছে। তবে কাজটি করবেন উদ্যোক্তারা। তাদের সঙ্গে আমরা অনেকবারই বসেছি। দেশে ১০০টি ইকোনমিক জোন হচ্ছে। কৃষিনির্ভরশীল জেলাগুলোয় যেন কৃষিভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয় এমন নির্দেশনা প্রধানমন্ত্রীও দিয়েছেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমরা ছোট ছোট উদ্যোক্তা তৈরিতে কাজ করছি। ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও আমরা যোগাযোগ রাখছি, কোন অঞ্চলে কী শিল্পপ্রতিষ্ঠান হতে পারে এবং বিনিয়োগে কী সুবিধা হতে পারে।’
কৃষি মন্ত্রণালয় উচ্চমূল্যের ফসল কীভাবে উৎপাদন করা যায় সে বিষয়ে গুরুত্বারোপ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, কৃষিনির্ভরশীল জেলাগুলোয় খাদ্য উদ্বৃত্ত ঠিকই থাকে, কিন্তু কৃষি ছাড়া বিকল্প কোনো কর্মসংস্থান গড়ে ওঠেনি। সম্পূর্ণ কৃষিনির্ভরশীলতার ফলে যারা দরিদ্র শ্রেণী আছে তারা সমস্যায় থাকে। কৃষিকে কীভাবে লাভজনক করা যায় সে বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রশিক্ষণও দেয়া হচ্ছে। তবে সার্বিকভাবে উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে।
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন দিনাজপুর প্রতিনিধি আসাদুল্লাহ সরকার ও সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি আল আমিন)
কোন মন্তব্য নেই