শিশুর চোখে সমস্যা দেখলেই সতর্ক হতে হবে
ছয় বছর বয়সী মুগ্ধ স্কুল থেকে ফিরে বলতেও পারত না স্কুলে কী পড়িয়েছে, এমনকি খাতায়ও কিছু লেখা থাকত না তার। অনেক পরে মা-বাবা বুঝলেন শিশুটি আসলে বোর্ডের কোনো লেখা দেখতেই পায় না। আবার পাঁচ বছর বয়সী কৃতি টিভি দেখত একেবারে কাছে গিয়ে। পরে জানা গেল, একটু দূরে থাকা টিভিটাও সে ঠিকমতো দেখে না। শিশুর এমন সব লক্ষণ দেখলেই সতর্ক হতে হবে অভিভাবকদের।
চোখ অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি অঙ্গ। তাই শিশুর চোখের যেকোনো সমস্যায় সচেতন হওয়া উচিত। শিশুর দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক নেই এমন কিছু সন্দেহ হলে দ্রুত শিশু চক্ষু বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। জেনে নিন শিশুদের চোখের কিছু সমস্যার বিষয়ে।
অদূরদর্শিতা বা মায়োপিয়া: এটি একটি দৃষ্টিশক্তির সমস্যা। এ রোগে আক্রান্ত শিশুরা কাছাকাছি থাকা কোনো কিছু স্পষ্ট দেখতে পায় কিন্তু দূরে থাকা কোনো কিছু ঝাপসা দেখে। এটি একটি জিনগত সমস্যা, তাই একেবারে ছোটবেলায় শিশু মায়োপিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। মায়োপিয়ার কারণ হলো আলোকরশ্মি রেটিনায় ফোকাস না করে তার সামনে ফোকাস করে। একটি চোখ স্বাভাবিকের চেয়ে দীর্ঘ হলে বা কর্নিয়া খুব বেশি বক্র হলে এমনটা হয়। সঠিক পাওয়ারের মাইনাস (-) লেন্সের চশমা দিয়ে দৃষ্টিশক্তি সংশোধন করা যায়, যা পরবর্তী সময়ে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন করা প্রয়োজন পড়ে।
দীর্ঘদৃষ্টি বা হাইপারোপিয়া: অবস্থাটি মায়োপিয়ার বিপরীত। এক্ষেত্রে শিশু দূরের বস্তুগুলো পরিষ্কার দেখে কিন্তু কাছের বস্তু ঝাপসা দেখে। হাইপারোপিয়ায় আক্রান্ত শিশুর চোখ স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা ছোট বা কর্নিয়ার বক্রতা কিছুটা চাপা হয়। ফলে আলোর রশ্মি রেটিনায় ফোকাস না করে রেটিনার বাহিরে/পেছনে ফোকাস করে। সঠিক পাওয়ারের প্লাস (+) লেন্স ব্যবহার করে দৃষ্টিশক্তি ঠিক করা যায়।
এস্টিগমাটিজম: কর্নিয়ার আকার যদি স্বাভাবিক থেকে ভিন্ন হয় তাহলেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়, যা শিশুর দৃষ্টিকে প্রভাবিত করে। এ অবস্থায় শিশু দূরের ও কাছের উভয় বস্তুই ঝাপসা দেখে। চোখের সামনের অংশের (কর্নিয়া) অসমান আকৃতির জন্য আলো সঠিকভাবে রেটিনার ওপর ফোকাস করতে পারে না, ফলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়। চশমা দিয়ে এসব শিশুরও দৃষ্টি স্পষ্ট করা যায়।
বাঁকা চোখ বা স্কুইন্ট: রোগটি সাধারণত ‘ট্যাঁরা চোখ’ নামেই পরিচিত। যখন এক বা উভয় চোখ ভেতরে, বাইরে, ওপরে বা নিচে ঘুরে যায় তখন এ রোগ ধরা পড়ে। এতে দুই চোখ একসঙ্গে এক বস্তুর দিকে লক্ষ করতে পারে না। এ অবস্থায় এটি যদি চিকিৎসা না করা হয় এবং শিশুর এর মধ্যে দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ পরিপূর্ণ/পরিপক্ব হয়ে যায় তখন এ রোগের চিকিৎসা কঠিন হয়ে যায়। সাধারণত জিনগত কারণে এ রোগ হয়ে থাকে, তবে আঘাত বা চোখের মাংসপেশির স্নায়ুর সমস্যা (স্ট্রোক) থেকেও এ রোগ হতে পারে। স্কুইন্ট নিজে থেকে ঠিক হয়ে যায় না। প্রাথমিকভাবে চোখের পাওয়ার নির্ণয়ের পর সঠিক চশমা দিলে কিছু ধরনের স্কুইন্ট ঠিক হয়ে যায়। তাছাড়া চেখের প্যাচিং দিয়েও অনেক ক্ষেত্রে বাঁকা চোখের দৃষ্টি বাড়াতে হয়। গুরুতর ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেয়া হয়।
অলস চোখ বা অ্যাম্বলাওপিয়া: এ রোগে একটি চোখ গঠনগতভাবে স্বাভাবিক হয়ে থাকে, তবে কার্যত দুর্বল হয়। অলস চোখ কম কাজ করে ফলে মস্তিষ্ক শেষ পর্যন্ত এর থেকে সিগনাল নেয়া বন্ধ করে দেয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্কুইন্টের ফলস্বরূপ এমনটা হয়ে থাকে অথবা যখন একটি চোখ অন্যটির চেয়ে অনেক কম দেখে (যেখানে দুই চোখে পাওয়ারজনিত সমস্যার উল্লেখযোগ্য রকম পার্থক্য থাকে) তখন এ সমস্যা হয়। অ্যাম্বলাওপিয়া চিকিৎসার ক্ষেত্রে চোখের স্নায়ুকে আরো উদ্দীপ্ত করতে অলস চোখকে দিয়ে বেশি কাজ করাতে হয়। অর্থাৎ ভালো চোখ/ শক্তিশালী চোখকে ব্লক/ প্যাচিং করে অলস চোখের ওপর জোর দিতে হয়। তাছাড়া কিছু সফটওয়্যার গেমসের মাধ্যমেও এ রোগের চিকিৎসা করা যায়।
ছানি: ছানি এমন একটি অবস্থা যেখানে চোখের স্বাভাবিক পরিষ্কার লেন্স ঘোলা হয়ে যায়। যার ফলে আলোর প্রবেশ বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং শিশুর দৃষ্টিতে সমস্যা দেখা যায়। এ সমস্যায় চিকিৎসা করানো না হলে শিশুর অন্ধত্বও হতে পারে। সাধারণত এটি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত রোগ। তাছাড়া মায়ের গর্ভকালীন সময়ে কিছু ইনফেকশনের কারণেও শিশু ছানি নিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে। যদি দৃষ্টি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়, তবে ছানি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারণ করে আর্টিফিশিয়াল লেন্স প্রতিস্থাপন করা হয়।
লাল/গোলাপি চোখ বা কনজাংটিভাইটিস: এটি কনজাংটিভার প্রদাহ বা লাল ভাব। কনজাংটিভা হচ্ছে চোখের সাদা অংশকে ঢেকে রাখা পরিষ্কার পাতলা ঝিল্লি। লালচোখ শিশুদের একটি সাধারণ রোগ। কনজাংটিভাইটিস সাধারণত ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে হয়ে থাকে। এটি অ্যালার্জির কারণেও হতে পারে। অন্য আক্রান্ত শিশুর সঙ্গে খেলা বা তার ব্যবহৃত বস্তু ব্যবহারের কারণে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিঅ্যালার্জিক চোখের ড্রপ ব্যবহার করতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই