ঢেলে সাজানো হচ্ছে রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘরকে, তবুও নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা
ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা (সিসি), স্ক্যানার বসানোসহ রাজশাহী বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরটিকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। তার পরেও দখলের দাপটে নিরাপত্তাহীনতায় ধুঁকছে এই মহামূল্যবান সম্পদে ভরা জাদুঘরটি। যেখানে রয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ, সেই জাদূঘরটির একেবারে প্রাচীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন। প্রাচীরের বাইরে গড়ে উঠা এসব ভবন থেকে অনায়াসে যাতায়াত করা যায় জাদুঘরের মূল ভবনে। ভবনেই রয়েছে প্রায় ১৭ হাজার প্রত্নতাত্তিক নির্দশন। যার মূল্য হাজার হাজার কোটি টাকা। মহা-মূল্যবান এই পত্নতাত্তিক সম্পদে ঠাসা ভবনের পাশজুড়ে ভবনগুলো দিনের পর দিন গড়ে উঠলেও কেউ কখনো বাধা বা আপত্তি তুলেনি। এতে করে চরম নিরপাত্তাহীনতা দেখা দিয়েছে এই জাদুঘরের।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইতিহাস চর্চার জন্য ১৯১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে রাজশাহী শহরের প্রাণকেন্দ্রে প্রতিষ্ঠা করা হয় আজকের বরেন্দ্র জাদুঘরটি। প্রথম দিকে যার নাম ছিল ‘বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি’। পরবর্তীতে নাম হয় বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। বিপুল সংখ্যক প্রত্ননিদর্শন, গবেষণা ও প্রকাশনার জন্য প্রতিষ্ঠার অল্পসময়ের মধ্যেই বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য চর্চার শ্রেষ্ঠ পাদপীঠে পরিণত হয় বরেন্দ্র জাদুঘরটি। যা ক্রমেই দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন ও বাংলাদেশের প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে ভরা জাদুঘরে পরিণত হয়। নাটোরের দিঘাপতিয়ার রাজ পরিবারের সন্তান দয়ারাপুরের খ্যাতিমান রাজা ইতিহাসানুরাগী কুমার শরৎকুমার রায় প্রতিষ্ঠা করেন এ জাদুঘরটি। বাংলার ইতিহাসের জনক খ্যাত প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ও বিশিষ্ট মানব তত্ত্ববেত্তা রমাপ্রসাদ চন্দ প্রমুখের সহায়তায় শরৎকুমার এই মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করেন।
জানা গেছে, এতোদিন পরে এসে এই জাদুঘরটিকে ঢেলে সাজানো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গোটা জাদুঘর আসছে সিসি ক্যামেরার আওতায়। এছাড়াও দর্শনার্থী ও প্রবেশকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শরীরসহ জাদুঘরের সব ধরনের মালামাল প্রবেশ ও বের করার সময় স্ক্যান করার জন্য বসছে স্ক্যানার মেশিন। এছাড়াও জাদুঘরটি সম্প্রতি প্রায় চারকোটি টাকা খরচ সংস্কার করা হয়েছে। বিদেশি অর্থায়নে এই সংস্কার নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। কোনো টেন্ডার ছাড়ায় শুধুমাত্র কোটেশনের ভিত্তিতে এই কাজগুলো করা হয়। তার পরেও জরাজীর্ণ হয়ে পড়া জাদুঘরটি এখন এসেছে চাকচিক্য। রং করা বাইরের দেয়ালগুলোর দিকে নজর পড়লে যেন মনে হয় নতুনের ছোয়া লেগেছে জাদুঘরটিতে।
এছাড়াও জাদুঘরটিতে আরো কয়েকটি বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য প্রকল্প অনুমোদনের চেষ্টা করছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে দেশের এই বৃহত্তম প্রাচীন প্রতিষ্ঠানটি। ফলে সবকিছু ঠিকঠাক মতো চললে একেবারে ঢেলে সাজানো হবে এই জাদুঘরটিকে। কিন্তু জাদুঘরের পাশেই বাইরের প্রাচীর ঘেঁষে যেসব বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে, সে ভবনগুলো নিয়ে দেখা দিয়েছে নিরাপত্তাহীনতা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, এই মূল ভবনের পশ্চিম পাশেই প্রাচীরের ওপারে রয়েছে ঘনবসতি। এই ঘনসতির মধ্যেই আবার কয়েকটি বাড়ি একেবারে প্রাচীরের ওপরে গিয়ে ঠেকেছে। এই বাড়িগুলো কোনোটি ৪ তলা আবার কোনোটি ৩ তলা, আবার কোনোটি ৫ তলা। অথচ বরেন্দ্র জাদুঘরটি দোতলা।
স্থানীয় নজরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি বলেন, তিন চারটি ভবন একেবারে প্রাচীরঘেঁেষ যেভাবে গড়ে উঠেছে, তাতে যে কোনো সময় মই দিয়ে বা লাফ দিয়েও জাদুঘরের মূল ভবনে যাওয়া সম্ভব। এতে করে চরমভাবে জাদুঘরের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই ভবনগুলো যে যার মতো করেছেন। কেউ কখনো বাধাও দেয়নি। ফলে জাদুঘরের পেছনের দিক দিয়ে যে রাস্তাটি আছে, সেটিও এখন আর নেই বললেই চলে। আবার জাদুঘরের পাশে লম্বা আরেকটি জায়গা রয়েছে, সেটিও দখল করে দোকানপাট ও ক্লাবঘর গড়ে উঠেছে। এভাবে দেশের বৃহত্তম সম্পদে ভরা জাদুঘরটির নিরাপত্তাই হুমকিরমুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।’
সচেতন নাগরিক কমিটির রাজশাহী জেলা সভাপতি আহমেদ শফি বলেন, ‘এই ধরনের একটি ঐতিহসিক স্থাপনার পাশে কোনো ভবনই হওয়া উচিত নয়। এতে করে যেমন জাদুঘরের সৌন্দর্যহানী হচ্ছে, তেমনি এখানকার নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই ভবনগুলো কিভাবে গড়ে উঠলো, সেটি ক্ষতিয়ে দেখে দ্রুত অপসারণ করা জরুরী।’
এদিকে জাদুঘরের একাধিক সূত্র মতে, এই জাদুঘরের গ্যালারি ও প্রবেশ দরজার সকল চাবি থাকতো একসময়ে তৃতীয় শ্রেণির পদধারি জাকির হোসেন নামের এক কর্মচারি কাছে। পরে তিনি সেকশন কর্মকর্তা হিসেবে পদন্নোতি পান। কিন্তু সম্প্রতি সেই চাবিগুলো জাদুঘরের নতুন পরিচালক আলি রেজা মুহাম্মদ আব্দুল মজিদ সংরক্ষণ করেন। কিন্তু জাকির হোসেনের কাছে যখন চাবি ছিল, তখনো পুরো অনিরাপদ ছিল এই জাদুঘরটি।
জানা যায়, বরেন্দ্র জাদুঘরে বর্তমানে প্রত্ননিদর্শন প্রদর্শিত হচ্ছে ১১টি গ্যালরি ও আভ্যন্তরিন বারান্দায়। প্রায় ১৭ হাজার প্রত্নতত্ত সামগ্রিতে ভরা এই জাদুঘরে এখন মাত্র ৩৫১টির মতো প্রত্নতত্ত সামগ্রি প্রদর্শন হচ্ছে। জায়গা সংকুলান না হওয়ায় বাকিগুলো রাখা হয়েছে মূল ভবনের গুদামে (স্টোরে)।
জানতে চাইলে বরেন্দ জাদু ঘরের পরিচালক আলী রেজা মুহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেন, ‘বাইরের কয়েকটি ভবন আমাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু ভবনগুলো কিভাবে গড়ে উঠেছে আমি বলত পারব না। এই ভবনগুলো হয়তো থাকবেও না। আমাদের জাদুঘরের ভিতরে আরো দুটি বহুতল ভবন গড়ে তলা হবে। তখন হয়তো বাইরের এসব ভবনগুলো উচ্ছেদ করা হবে। আবার বাইরের আরেকটি মূল্যবান জায়গাও দখল করেছে কেউ কেউ। সেগুলোই উচ্ছেদ করা হবে। তাহলেই জাদুঘরটির সৌন্দর্য যেমন বজায় থাকবে, তেমনি নিরাপত্তা ব্যবস্থাও সঠিক থাকবে।’

কোন মন্তব্য নেই