ভালো নেই ব্র্যাক ব্যাংক - TIMES EXPRESS | টাইমস এক্সপ্রেস is an interactive news portal

নিউজ ফাস্ট

ভালো নেই ব্র্যাক ব্যাংক

 



মৌলিক বিভিন্ন সূচক, বিদেশী বিনিয়োগ ও বহুমাত্রিক কর্মকাণ্ড বিবেচনায় দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকগুলোর একটি ব্র্যাক ব্যাংক। গত কয়েক বছরে আমানত, ঋণ ও সম্পদের প্রবৃদ্ধির দিক থেকে ব্যাংকটির সাফল্য ঈর্ষণীয়। এসএমই ও রিটেইলের মতো অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং সেবায়ও ব্র্যাক ব্যাংকের অবস্থান সামনের সারিতে। ‘বিকাশ’-এর মতো মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানের মালিকানায়ও রয়েছে ব্যাংকটি। কিন্তু গত কয়েক বছরে অস্বাভাবিক উত্থানের পর বড় পতনের দিকেই যাচ্ছে ব্র্যাক ব্যাংক।


যেকোনো ব্যাংকের আকার ও সম্পদ বাড়লে মুনাফাও বাড়বে—এটিই নিয়ম। এ নিয়মের ধারাবাহিকতায় ছিল ব্র্যাক ব্যাংকও। কিন্তু তিন বছর ধরে উল্টোরথে চলছে ব্র্যাক ব্যাংকের কার্যক্রম। ২০১৮ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের সম্পদের প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৯৮ শতাংশ। বিপরীতে ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ ছিল নিট মুনাফায় প্রবৃদ্ধি। তবে পরের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে ব্যাংকটির সম্পদের প্রবৃদ্ধি ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ হলেও নিট মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৭৮ শতাংশ। সম্পদ বাড়লেও নিট মুনাফার চিত্র আরো হতাশাজনক ছিল চলতি বছরে। করোনা মহামারীর ধাক্কায় চলতি বছরের প্রথমার্ধে ব্র্যাক ব্যাংকের নিট মুনাফা কমেছে ৬২ শতাংশ।


দেশে সবচেয়ে বিস্তৃত এমএফএস ‘বিকাশ’ নিয়েও চিন্তায় আছে ব্র্যাক ব্যাংক। ২০১৯ সালে ৬২ কোটি টাকা নিট লোকসান দিয়েছে বিকাশ। চলতি বছরের প্রথমার্ধে এ লোকসানের পাল্লা আরো ভারী হয়েছে। একই পরিস্থিতি ব্র্যাক ব্যাংকের অন্য তিনটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠানেরও। চলতি জুন শেষে ব্র্যাক ব্যাংকের চারটি সাবসিডিয়ারিই লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।


ব্র্যাক ব্যাংকের ঋণ পোর্টফোলিওর ৪৫ শতাংশই এসএমই। পাশাপাশি ১৮ শতাংশ বিনিয়োগ আছে রিটেইল খাতে। এসএমই ও রিটেইলে দেয়া ঋণে ১৫-৩০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ আদায় করত ব্র্যাক ব্রাংক। ঋণের এ উচ্চসুদে লাগাম দিয়েছে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরের ১ এপ্রিল থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে ব্র্যাক ব্যাংককে বাধ্য করা হয়েছে। সুদ কমানোর বড় ক্ষতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনাভাইরাস সৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগও। সব মিলিয়ে ব্যাংকটি বিপর্যয় কাটিয়ে মুনাফায় প্রবৃদ্ধিতে আসতে অনেক সময় লাগবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এজন্য ব্যয় কমিয়ে মুনাফা বাড়াতে কস্ট টু ইনকাম রেশিও অন্তত ৯ শতাংশ কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে ব্র্যাক ব্যাংক।


সুদহারের উত্থান-পতনের কারণে ২০১৯ সালে মুনাফায় প্রবৃদ্ধি কম ছিল বলে মনে করেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ব্র্যাক ব্যাংকের ঋণ পোর্টফোলিওর ৪৫ শতাংশ এসএমই খাতে। এ খাতে আমাদের মার্জিন ছিল ১৪-১৫ শতাংশ। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক সুদহার বেঁধে দেয়ার কারণে তা এখন ৯ শতাংশ নামিয়ে আনা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ব্র্যাক ব্যাংকের মুনাফা কমবে, এটিই স্বাভাবিক। আর চলতি বছর বিশ্বের সব ব্যাংকেরই মুনাফা কমবে।


কোনো দেশের অর্থনীতি চাপে থাকলে ব্যাংক ভালো থাকার সুযোগ নেই বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) এ নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেন, সুশাসনের ঘাটতির কারণেও দেশের ব্যাংকিং খাত দিন দিন দুর্বল হচ্ছে। ব্র্যাক ব্যাংকে করপোরেট গভর্ন্যান্স শক্তিশালী। এজন্য আমাদের ঝুঁকিও কম।


২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে সেলিম আরএফ হুসেইন যোগ দেন। ওই সময় ব্র্যাক ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা। মাত্র চার বছরের ব্যবধানে ২০১৯ সাল শেষে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণ ২৬ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সে হিসেবে এ চার বছরে ব্র্যাক ব্যাংকের ঋণ পোর্টফোলিওর আকার বেড়েছে ৭৯ শতাংশের বেশি।


গত চার বছরে ব্র্যাক ব্যাংকের মোট সম্পদের পরিমাণও প্রায় ৬৪ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৫ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। ২০১৯ সাল শেষে ব্যাংকটির সম্পদের পরিমাণ ৩৬ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সম্পদসহ অন্যান্য কার্যক্রম বাড়ায় ২০১৬ সাল থেকে ব্র্যাক ব্যাংকের নিট মুনাফায়ও উল্লম্ফন হয়। এ ধারাবাহিকতা ছিল ২০১৭ সাল পর্যন্ত। কিন্তু ২০১৮ সাল থেকে সম্পদ বাড়লেও মুনাফার প্রবৃদ্ধি থমকে গেছে ব্র্যাক ব্যাংকের। ২০১৮ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ১৩ শতাংশ। বিপরীতে নিট মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এরপর ২০১৯ সালে ব্যাংকটির সম্পদে ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও নিট মুনাফায় প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৭৮ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের পরিচালন মুনাফাও প্রায় আড়াই শতাংশ হারে কমেছে।


মুনাফার প্রবৃদ্ধি থমকে যাওয়ায় ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস), সম্পদের বিপরীতে আয় (আরওএ) এবং ইক্যুইটির বিপরীতে আয় (আরওই) কমেছে। মৌলিক এ তিনটি সূচকে অবনমন হওয়ায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ারদরেও। গত বৃহস্পতিবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ারদর ছিল ৩৮ টাকা ৯০ পয়সা। যদিও গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকটির শেয়ারদর ৬০ টাকারও বেশি ছিল।


পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে বিদেশী বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি ব্র্যাক ব্যাংকে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটিতে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ৪৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ। কিন্তু চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ব্র্যাক ব্যাংকে বিদেশী বিনিয়োগ সাড়ে ৪ শতাংশ কমেছে। চলতি বছরের আগস্ট শেষে ব্র্যাক ব্যাংকে বিদেশী বিনিয়োগ ৩৯ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। ১ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের ব্র্যাক ব্যাংকের মোট শেয়ার সংখ্যা ১৩২ কোটি ৫৮ লাখ ৭৮ হাজার ৪৭৬। এ শেয়ারের ৪৪ দশমিক ২৯ শতাংশ এককভাবে ধারণ করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক।


এসএমই খাতে বিনিয়োগকে ব্র্যাক ব্যাংকের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা ধরা হয়। ব্যাংকটির ঋণ পোর্টফোলিওর ৪৫ শতাংশই এসএমই খাতে। চলতি বছরের জুন শেষে এসএমই খাতে ব্র্যাক ব্যাংকের ঋণ ছিল ১১ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। মোট ৩ লাখ ২৯ হাজার ৩৯৯ এসএমই গ্রাহককে এ ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি। ব্র্যাক ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের ১৮ শতাংশ রিটেইলে। ক্রেডিট কার্ড, গাড়ি-বাড়ির ঋণের মতো ছোট ছোট ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা। ৯ লাখ ৮২ হাজার ১৭৬ রিটেইল গ্রাহক রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংকের।


এসএমই ও রিটেইলে দেয়া বড় অংকের এ ঋণের বিপরীতে ১৫-৩০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ আদায় করত ব্র্যাক ব্যাংক। ব্যাংকটির মুনাফার বড় অংশও এ দুটি খাতের ঋণ থেকেই আসত। কিন্তু সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে। ১ এপ্রিল থেকে এ সুদহার কার্যকর হওয়ায় জুনের মধ্যেই ব্র্যাক ব্যাংকের নিট মুনাফা কমেছে ৬২ শতাংশ।


তবে ঋণের ৯ শতাংশ সুদের বাধ্যবাধকতার কারণে এ মুহূর্তে ব্র্যাক ব্যাংকের সমস্যা হচ্ছে না বলে জানান ব্যাংকটির শীর্ষ নির্বাহী সেলিম আর এফ হুসেইন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, রেমিট্যান্সে বড় প্রবৃদ্ধি, প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থছাড়সহ নানা কারণে বাজারে এ মুহূর্তে প্রচুর তারল্য আছে। এতে আমানতের কস্ট অব ফান্ড ২-৩ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। আমাদের কস্ট অব ফান্ডের যে পরিস্থিতি তাতে এসএমই ও রিটেইলে ৯ শতাংশ সুদে বিনিয়োগে সমস্যা হচ্ছে না।


যদিও ব্র্যাক ব্যাংক মুনাফার বিপর্যয় দ্রুতই কাটিয়ে উঠবে বলে মনে করেন না ব্যাংকটিরই একাধিক কর্মকর্তা। তারা বলছেন, করোনাভাইরাস সৃষ্ট অর্থনৈতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোর শীর্ষ রয়েছে এসএমই। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও এসএমই উদ্যোক্তারা ঘুরে দাঁড়াতে দীর্ঘ সময় লাগবে। ব্র্যাক ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের বড় অংশই খেলাপি হতে বাধ্য হবে। এ পরিস্থিতিতে খেলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে গিয়েই ব্র্যাক ব্যাংককে হিমশিম খেতে হবে।


বর্তমান পরিস্থিতিতে মুনাফার দিকে তাকানোর সুযোগ নেই বলে মনে করেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, এ বছর ব্র্যাক ব্যাংকের লক্ষ্য মুনাফা করা নয়। আমাদের গ্রাহকরা যেন বেঁচে থাকে, সে লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছি। উদ্যোক্তা ভালো হলে কোনোভাবেই যেন ঋণবঞ্চিত না হন, সে চেষ্টা করা হচ্ছে।


এমএফএস প্রতিষ্ঠান ‘বিকাশ’কে দেখা হয় ব্র্যাক ব্যাংকের বড় সফলতা হিসেবে। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানটির অব্যাহত লোকসানই ব্র্যাক ব্যাংককে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ২০১৯ সালে ৬২ কোটি টাকা নিট লোকসান দিয়েছে ‘বিকাশ’। যদিও ২০১৮ সালে ২০ কোটি টাকা নিট মুনাফায় ছিল প্রতিষ্ঠানটি। চলতি বছরের প্রথমার্ধে বিকাশের লোকসানের পাল্লা আরো ভারী হয়েছে। জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি নিট লোকসান দিয়েছে ৩৬ কোটি টাকা। ব্যবসাসফল বিকাশের ধারাবাহিক লোকসান ব্র্যাক ব্যাংকের উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।


বিকাশের মতোই লোকসানের বৃত্তে বন্দি ব্র্যাক ব্যাংকের অন্য তিন সাবসিডিয়ারিও। চলতি বছরের প্রথমার্ধে ব্র্যাক ইপিএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ১৩ কোটি, ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজ লিমিটেড ৭ কোটি এবং ব্র্যাক সাজন এক্সচেঞ্জ লিমিটেড ১ কোটি টাকা নিট লোকসান গুনেছে। ২০১৯ সালে ব্র্যাক ইপিএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ৩৬ কোটি এবং ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজ লিমিটেড ৮ কোটি টাকা লোকসানে ছিল।


বিকাশের মতো সফল প্রতিষ্ঠানও লোকসান দিচ্ছে কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রযুক্তিনির্ভর কোম্পানিগুলো কার্যক্রমে আসার শুরুর দিকে লোকসানে থাকে। বিকাশের ক্ষেত্রেও এখন পর্যন্ত তা-ই হচ্ছে। বিকাশ এখন পর্যন্ত কার্যক্রম সম্প্রসারণ, নতুন নতুন সেবার সংযুক্তি ও গ্রাহক আকৃষ্ট করাতেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছে বলে আমাদের জানিয়েছে।



সূত্র: বণিক বার্তা 

কোন মন্তব্য নেই