কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে ফ্যামিলিটেক্সের মালিকরা লাপাত্তা
ফ্যামিলি টেক্সের উদ্যোক্তা পরিচালকরা ঘোষণা না দিয়ে বেআইনিভাবে তাদের হাতে থাকা প্রায় সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। আর ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারের দাম এখন পড়তে পড়তে তলানিতে এসে ঠেকেছে।
গত বছর শেয়ারের দাম একপর্যায়ে কমে এক টাকা ৬০ পয়সায় নেমে আসে। সম্প্রতি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের খবরে কয়েক দিন দাম বেড়েছে। তাও তা তিন টাকার নিচে বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ মালিকপক্ষ যে টাকায় শেয়ার বিক্রি করেছে, এখন সব শেয়ার কিনতে পারবে তার ভগ্নাংশ দিয়ে।
চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) একটি প্রতিষ্ঠান ফ্যামিলিটেক্স লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি ২০০৬ সালে বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসে কোম্পানিটি।
পুঁজিবাজারে ২০১৩ সালে তালিকাভুক্তির পর ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত হিসাব বছরে কোনো ডিভিডেন্ড দেয়নি। তবে ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত হিসাব বছরের জন্য ১০০ শতাংশ বোনাস ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকরা।
ওই বছর কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় দেখানো হয় ৭ টাকা ২৬ পয়সা আর শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য হয় ২১ টাকা ৭২ পয়সা। ডিভিডেন্ ঘোষণার পর দিন ১ এপ্রিল কোম্পানিটির শেয়ার দর দাঁড়ায় ৬২ টাকা, যদিও একপর্যায়ে দাম ৭৪ টাকা ৮০ পয়সায় উঠেছিল।
বিপুল পরিমাণ বোনাস শেয়ার দেয়ার পর থেকেই ফ্যামিলিটেক্সের আয় কমতে থাকে। ২০১৫ থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত সমাপ্ত হিসাব বছরে কোম্পানিটি সব শেষ মুনাফা করেছিল। তখন শেয়ারপ্রতি আয় হয় ৮২ পয়সা। এর পরের চার বছর ধরে লোকসান দিচ্ছে কোম্পানিটি।
২০১৭ সালে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় সাড়ে ৪ পয়সার মতো। পরের বছর লোকসান হয় ৭ পয়সা, ২০১৯ সালে লোকসান হয় ৮ পয়সা। আর ২০২০ সালে লোকসান হয় ১৫ পয়সা।
চলতি অর্থছরের প্রথম ছয় মাসে লোকসান হয়েছে ১৩ পয়সা। বৃহস্পতিবার (১৮ মার্চ) ফ্যামিলিটেক্সের শেয়ারের দর ছিল ২ টাকা ৭০ পয়সা।
২০১৩ সালে ১০০ শতাংশ বোনাস শেয়ার ডিভিডেন্ড হিসেবে দেয়ার পরের বছর কোম্পানিটি দেয় আরও ১০ শতাংশ বোনাস। এর পরের তিন বছর দেয় ৫ শতাংশ করে। কিন্তু গত দুই বছর কোনো ডিভিডেন্ডই দেয়া হয়নি।
অথচ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে কোম্পানির আয় ক্রমেই বাড়ছিল। তালিকাভুক্তির আগে তিন বছরের আর্থিক প্রতিবেদন জমা দিতে হয় বিএসইসিতে।
সেখানে দেখা গিয়েছিল ২০১১ ও ২০১২ সালে কোম্পানিটির মুনাফা বেড়েছিল চার গুণের বেশি। আর তালিকাভুক্ত হওয়ার বছরে মুনাফা বাড়ে আরও ৭৬ শতাংশ।
বেআইনিভাবে শেয়ার বেচলেও সাজা হয়নি : ৩৫৪ কোটি ১০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটির ৪.০২ শতাংশ শেয়ারের মালিক এর উদ্যোক্তা পরিচালকরা। যদিও আইন অনুযায়ী ৩০ শতাংশ শেয়ার থাকতে হবে তাদের হাতে।
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ১৮.৪১ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৭৭.৫৭ শতাংশ শেয়ার আছে।
সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার বিক্রি করতে হলে পুঁজিবাজারে ঘোষণা দিতে হয়। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা-পরিচালকরা তাও করেননি।
বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি গত ডিসেম্বরের শেষে বিষয়টি নিয়ে তদন্তে একটি কমিটি গঠন করে দেয়।
এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে তাতে দেখা যায়, কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেরাজ-ই-মোস্তফা ২০১৮ সালের অক্টোবরে তার নিজ নামের ১ কোটি ৬৯ লাখ ২৬ হাজার শেয়ার বিনা ঘোষণায় বিক্রি করেছেন, যা ওই দিনে ডিএসইতে কোম্পানিটির বিক্রি হওয়া শেয়ারের প্রায় ৯৩ শতাংশ।
প্রায় একই সময়ে প্রতিষ্ঠানটির আরেক পরিচালক রোকসানা মোরশেদ ৯২ লাখ ৪০ হাজার শেয়ার সাড়ে ৭ কোটি টাকায় বিক্রি করেছেন।
তিনি ২০১৭ সালের বিভিন্ন সময়ে চার দফায় ৫ কোটি ১৮ লাখ শেয়ার প্রায় ৫৬ কোটি টাকায় বিক্রি করেন। তার সাবেক স্বামী ও ফ্যামিলিটেক্সের উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোরশেদও একই সময়ে সোয়া ২৩ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করে দেশের বাইরে চলে যান।
উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার বিক্রি তদন্তে কমিটি: গত ২৮ ডিসেম্বর ফ্যামিলিটেক্সের পরিচালকদের বিএসইসিকে না জানিয়ে শেয়ার বিক্রির তথ্য অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
কমিটির সদস্যরা ছিলেন উপপরিচালক রাকিবুর রহমান ও সহকারী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম। কমিটিকে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছিল।
এ বিষয়ে বিএসইসি নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, তদন্ত ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। কোম্পানিটির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ইনফোর্সমেন্ট বিভাগে পাঠানো হচ্ছে।’
পর্ষদ পুনর্গঠন করে কোম্পানি বাঁচানোর চেষ্টা: বন্ধ ও লোকসানি কোম্পানিগুলোর পর্ষদ পুনর্গঠনের অংশ হিসাবে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসএসি ফ্যামিলিটেক্সে ছয়জন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেয়।
তারা হলেন কাজী আমিনুল ইসলাম, ড. সামির কুমার শীল, ড. গাজী মোহাম্মদ হাসান জামিল, ড. মো. জামিল শরিফ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরিফ এহসান ও ড. মো. ফরজ আলী। ছয়জনের মধ্যে বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন কাজী আমিনুল ইসলাম।
কোম্পানির আর্থিক অবস্থা যাচাই-বাছাই করে কীভাবে কোম্পানিটি আবার চালু করা যায় সে বিষয়ে কমিশনকে জানাবেন তারা।
কী করবেন স্বতন্ত্র পরিচালকরা: কোম্পানির আর্থিক অবস্থা পর্যালোচনা করাসহ কীভাবে কোম্পানিটিকে আগের অবস্থায় বা উৎপাদনে ফিরিয়ে আনা যায় তা নিয়ে কাজ করবেন স্বতন্ত্র পরিচালকরা। এ ছাড়া কোম্পানির কোনো অসঙ্গতি থাকলে সেটি নিয়েও কাজ করবে পুনর্গঠিত বোর্ড।
এ বিষয়ে বিএসইসি কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, আমরা চেষ্টা করছি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বন্ধ ও লোকসানি কোম্পানিগুলোকে চালু করতে। দীর্ঘদিন এসব কোম্পানি বন্ধ থাকার কারণ বিদ্যমান বোর্ডে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন না করা। এ জন্য আমরা কোম্পানিগুলোতে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিচ্ছি।’
কী করবে স্বতন্ত্র পরিচালকরা প্রশ্নে তিনি বলেন, কোম্পানিটিকে চালু করার প্রাথমিক কাজটি তারা করবেন। পরবর্তীতে কেউ যদি কোম্পানিগুলো নিয়ে চালু করতে চায় তাহলে সেভাবে উদ্যোগ নেয়া হবে।

কোন মন্তব্য নেই