৬ হাজার কোটি টাকার তহবিল চায় শিল্প মালিকরা
সম্প্রতি অর্থমন্ত্রীর কাছে দেয়া একটি চিঠিতে এ দাবি জানিয়েছেন অ্যাসোসিয়েশন অব এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড শিপ বিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রিজ অব বাংলাদেশের (এইওএসআইবি) সভাপতি ড. আব্দুল্লাহিল বারী। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
অর্থমন্ত্রীর কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ২০০৭ সাল থেকে বাংলাদেশ থেকে মোট ৪০টি জাহাজ রফতানির মাধ্যমে আনুমানিক ১২০ মিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে। প্রতি বছর অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে দেশের জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ১০০টিরও বেশি জাহাজ নির্মাণ করে। ফলে এ শিল্প আমদানি বিকল্পে বিশাল ভূমিকা রাখছে। কেননা অতীতে আমাদের মূল্যবান বৈদিশেক মুদ্রা ব্যয়ে এসব জাহাজ ইউরোপ ও চীন থেকে আমদানি করতে হতো। তাছাড়া এ খাতে বর্তমানে ৫০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী সরাসরি নিয়োজিত রয়েছেন। এ শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত অসংখ্য ছোট-বড় পশ্চাত্পদ সংযোগ শিল্প যেমন কেবলস, ফার্নিচারস, পেইন্টস ইত্যাদির মাধ্যমে পরোক্ষভাবে প্রায় ৩ লাখ শ্রমজীবী মানুষ কাজ করছে।
এ অবস্থায় এইওএসআইবি বলছে, ২০১০ সাল থেকে উচ্চহারের সুদের ঋণের কারণে এ খাত চরম আর্থিক সংকটে ভুগছে। তাছাড়া ২০০৮ সাল থেকে দীর্ঘ সময় ধরে চলমান বিশ্বমন্দার প্রভাবে ইউরোপীয় ক্রেতারা বেশকিছু রফতানি কার্যাদেশ বাতিল করেছে। এতে করে শীর্ষ রফতানিমুখী জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিপুল পরিমাণ রফতানি মূল্য হারিয়েছে। এমনকি বেশকিছু জাহাজ নির্মাণকাজ শেষ হলেও সেগুলো রফতানি করতে পারেনি। তার ওপর বিশ্ব করোনা মহামারীর প্রভাবে এ শিল্পে অনেক সংখ্যক কার্যাদেশ বাতিল হয়েছে। একই সঙ্গে চলমান প্রকল্পের কাজেও বিঘ্ন ঘটেছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, কভিড-১৯-এ ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের উদ্যোক্তারা আবেদন করেও সেখান থেকে কোনোরূপ আর্থিক সহায়তা পায়নি। এরই মধ্যে এ শিল্পের উদ্যোক্তারা ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা উচ্চ হারের সুদে ঋণ নিয়েছিল, জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সেই সুদ ও ঋণের ভারে জর্জরিত।
এ চিঠির বিষয়ে কথা হয় এইওএসআইবি সভাপতি ও আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়েজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ড. আব্দুল্লাহ হেল বারীর সঙ্গে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বেশ কয়েক বছর আগে এ খাতের উদ্যোক্তারা সর্বমোট প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিল। কিন্তু ২০০৮ সাল থেকে চলমান বিশ্বমন্দায় জাহাজ নির্মাণ মালিকরা অনেক ক্ষতিতে পড়ে। তাই সেই ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। উচ্চ সুদহার হওয়ার কারণে সেই ঋণই এখন ৫-৬ হাজার কোটি টাকায় পরিণত হয়েছে। এসব ঋণ পরিশোধসহ জাহাজ শিল্প রক্ষায় অনেক দিন থেকেই এ ধরনের তহবিল গঠন করার আলোচনা হচ্ছিল। কিন্তু সেটি বাস্তবায়ন হয়নি।
তিনি আরো বলেন, এবার বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরসহ অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করে চলতি বছরেই ‘জাহাজ নির্মাণ শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা ২০২১’ করা হয়েছে। ওই নীতিমালায়ও এ ধরনের তহবিল গঠনের কথা বলা হয়েছে। সে আলোকেই আগামী বাজেটে ৬ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করার অনুরোধ জানিয়ে অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। এ তহবিল গঠনের ও তা বিতরণের মাধ্যমে যদি জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে সচল করা যায়, তাহলে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী জাহাজ শিল্পের জন্য যে সুযোগ তৈরি হয়েছে তা গ্রহণ করতে পারবে বাংলাদেশ।
বৈশ্বিক সমুদ্র পরিবহনে ভাড়া প্রায় ৫০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে চিঠিতে আরো বলা হয়, নতুন করে বেশকিছু আন্তর্জাতিক নৌ প্রবিধান জারি হওয়ায় বিশ্ববাজারে জাহাজের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। সরকার থেকে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো অনায়াসে এসব নতুন জাহাজ নির্মাণের চাহিদা মেটাতে সক্ষম। অন্যথায় প্রযুক্তিগত জ্ঞান, যথাযথ নির্মাণ স্থাপনা এবং সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এসব সুযোগ আমরা প্রতিযোগী দেশগুলোর কাছে হারাব।
এরই মধ্যে এ সম্ভাবনাময় খাতের সংকট নিরসনের লক্ষ্যে সম্প্রতি ‘জাহাজ নির্মাণ শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা ২০২১’ গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে সরকার। তাই এ বৃহৎ শিল্পের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও এ খাতে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনরুদ্ধারের জন্য নীতিমালার আলোকে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে ৬ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল আবশ্যক। এ তহবিল কীভাবে বাস্তবায়িত হবে তারও একটি প্রস্তাব দিয়েছে অ্যাসোসিয়েশন।
তারা বলছে, ৬ হাজার কোটি টাকার মধ্যে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা থেকে ক্ষতিগ্রস্ত রফতানিমুখী জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্রিয় রাখার জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার একটি নিবেদিত তহবিল গঠন করতে হবে। এ তহবিল থেকে ক্ষতিগ্রস্তরা আড়াই থেকে ৩ শতাংশে ঋণ নিয়ে পাঁচ বছর মরাটোরিয়ামসহ ২৫ বছরে পরিশোধ করবে। এ তহবিল থেকে ঋণ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো আগের দায় পরিশোধ ও অ্যাডজাস্টমেন্টের কাজে ব্যবহার করবে।
এছাড়া ১ হাজার কোটি টাকার একটি চলতি মূলধন তহবিল গঠন করতে হবে। এ তহবিল থেকে চলমান করোনা মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ নিয়ে তাদের কাজ চলমান রাখবে। এছাড়া সভরিন ব্যাংক গ্যারান্টি (নন-ফান্ডেড) প্রদানের জন্যও তহবিল গঠন করার অনুরোধ জানানো হয়েছে, যা জাহাজ রফতানির জন্য জরুরি ভিত্তিতে করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই