ব্যাপক ধসের শঙ্কা মিয়ানমারের অর্থনীতিতে
মিয়ানমারে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখলের পর প্রায় তিন মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। দেশটিতে গণতন্ত্রের দাবিতে বিক্ষোভ দিন দিন বড় সংঘাতের দিকে রূপ নিচ্ছে। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে প্রায় প্রতিদিনই প্রাণ ঝরছে মিয়ানমারের রাজপথে। অন্যদিকে বিক্ষোভকারীদের সমর্থনে দেশটির জাতিগত বিদ্রোহী দলগুলো নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা জোরদার করছে। প্রয়োজনে সর্বাত্মক সংঘাতের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিদ্রোহীরাও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গোলযোগপূর্ণ এ পরিস্থিতিরই প্রভাব পড়তে যাচ্ছে মিয়ানমারের অর্থনীতিতে। দেশটির অর্থনীতির এ সংকটকে আরো প্রকট করে তুলছে কভিড-১৯-এর সংক্রমণ।
চলতি বছরে মিয়ানমারের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে এরই মধ্যে বিভিন্ন সংস্থার প্রাক্কলন প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) উভয়ের আশঙ্কা, ২০২১ সালে মিয়ানমারের অর্থনীতি সংকুচিত হবে প্রায় ১০ শতাংশ হারে। অন্যদিকে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বলছে, চলতি বছর শেষ হওয়ার আগেই দারিদ্র্যে পতিত হতে যাচ্ছে দেশটির প্রায় অর্ধেক নাগরিক।
অথচ চলতি বছরের শুরুতেও দেশটির অর্থনীতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে এতটা হতাশা ছিল না। সে সময় পূর্বাভাস ছিল, চলতি বছরে করোনার প্রভাব কাটিয়ে বর্মি অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি হতে যাচ্ছে প্রায় ৬ শতাংশ। কিন্তু সবকিছু বদলে যায় গত ১ ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানের পর। ক্ষমতা দখলের পর দেশটির সামরিক বাহিনীর কর্তারা নিজেদের ব্যবসাবান্ধব হিসেবে উপস্থাপনের প্রয়াস চালিয়েছেন। এমনকি জরুরি অবস্থার মধ্যেও অর্থনৈতিক নীতিমালায় কোনো পরিবর্তন আসবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন তারা। এজন্য আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ রয়েছে এমন ব্যক্তিদের অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও দেয়া হয়েছিল। তার পরও মিয়ানমারের অর্থনৈতিক বিপদ কাটিয়ে উঠতে পারেনি জান্তা সরকার। দেশটির অর্থনীতিতে ব্যাপক ধসের বেশকিছু লক্ষণ এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এক দশক আগেও মিয়ানমারকে বলা হতো এশিয়ার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ফ্রন্টিয়ার মার্কেট। কিন্তু সে ভাবমূর্তি এরই মধ্যে হারিয়ে ফেলেছে দেশটি। অভ্যুত্থানের পর থেকে সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় দেশটির অনেক বিনিয়োগকারীই এখন বিনিয়োগ গুটিয়ে নিচ্ছেন। সামরিক জান্তার পক্ষ থেকে মার্চে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইতালি ও ফ্রান্সের চেম্বার অব কমার্সকে আলোচনার আহ্বান জানানো হয়েছিল। বাণিজ্য সংগঠনগুলো এ আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে। অন্যদিকে কোকাকোলা, টেলিনর, হেনিকেনসহ ৫০টি বহুজাতিক কোম্পানি এরই মধ্যে মিয়ানমারের বিদ্যমান ব্যবসায়িক পরিবেশ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বক্তব্য দিয়েছে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গত এক দশকে মিয়ানমারের অর্থনীতিতে বেশকিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল এবং এ সময় দেশটি অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা অগ্রসরও হয়েছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের এক সময়কার সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর অন্যতম মিয়ানমার এখন চরম দারিদ্র্যে নিপতিত হতে চলেছে। একই সঙ্গে বর্মি অর্থনীতি নেমে এসেছে মহাবিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে।
করোনার অভিঘাত কাটিয়ে দেশটির অর্থনীতিতে প্রত্যাবর্তনের যাবতীয় সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করে দিয়েছে সামরিক অভ্যুত্থান। ইউএনডিপির ভাষ্যমতে, সামরিক জান্তার উদ্যত ভূমিকা ও নাগরিক পর্যায়ে ব্যাপকমাত্রায় অসহযোগ আন্দোলনের কারণে মিয়ানমারের ব্যবসা-বাণিজ্য এখন বন্ধ। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবিরতা থেকে ক্রমেই পেছাচ্ছে পতনের দিকে। এর ধারাবাহিকতায় চলতি বছর ১ কোটি ২০ লাখ লোক মারাত্মক আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে।
সংস্থাটির আঞ্চলিক সহকারী মহাসচিব কান্নি উইগনারাজা সম্প্রতি এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক একটি বার্তা সংস্থাকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের নগরাঞ্চলের অধিবাসীরাই মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে যেসব পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী নারী, সেসব পরিবারই সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
করোনার কারণে মিয়ানমারে গড় মজুরি নেমে এসেছে প্রায় অর্ধেকে। এর মধ্যেই রাজনৈতিক গোলযোগ দেশটির উৎপাদন ও সেবা খাতে বড় ধরনের আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠেছে। বর্তমানে মিয়ানমারের অনেক কারখানা, অফিস, ব্যাংক ও অন্যান্য সেবা প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। উৎপাদন ও বাণিজ্যও এক প্রকার বন্ধ। এ অবস্থায় ২০২২ সালের মধ্যেই মিয়ানমারের দারিদ্র্য পরিস্থিতি ২০০৫ সালের পর্যায়ে ফিরে যেতে পারে বলে আশঙ্কা ইউএনডিপির। সংস্থাটির ভাষ্যমতে, শুধু রাজনৈতিক সংকটের দ্রুত সমাধানের মাধ্যমেই এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব। তবে বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, সে সম্ভাবনা একেবারেই অনুপস্থিত।
মিয়ানমারের সরকারি বিনিয়োগ সংস্থার পরিসংখ্যান দিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, দেশটিতে নতুন কোম্পানি নিবন্ধনের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমছে। জান্তা সরকার ক্ষমতা গ্রহণের কারণে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) দেশটিতে নতুন কোম্পানি নিবন্ধনের সংখ্যা কমেছে প্রায় ৮৭ শতাংশ।
অন্যদিকে দেশটিতে সামরিক জান্তা ক্ষমতা গ্রহণের আগে ডিজিটাল অর্থনীতি ও ফিনটেকের বাজারও সম্প্রসারিত হচ্ছিল। কিন্তু ক্ষমতা দখলের পর বিরোধীদের দমনের অন্যতম পন্থা হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ বা সীমিত করে আনার পথ বেছে নিয়েছে তাতমাদো (মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর আনুষ্ঠানিক নাম)। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, এ ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের কারণে মোবাইল লেনদেন থেকে শুরু করে ই-কমার্স ও অনলাইন ফুড ডেলিভারি সেবা পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সব ব্যবসাই ব্যাপকমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে মার্চের পর থেকে মোবাইল ইন্টারনেট ও ব্রডব্যান্ড সেবায় বারবার ব্যাঘাত ঘটানোর কারণে মোবাইল লেনদেন সেবা রীতিমতো পঙ্গু হয়ে পড়েছে। ই-কমার্স সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা হারিয়েছে প্রায় ৭৫ শতাংশ। অনলাইন ফুড ডেলিভারি সেবার ক্ষেত্রে এ ধসের হার ৮০ শতাংশ।
পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বৃহৎ খাত গার্মেন্ট শিল্প। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বৈশ্বিক ক্রেতারা এরই মধ্যে দেশটি থেকে প্রচুর পরিমাণে ক্রয়াদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। শিল্প এলাকাগুলোয় নেপিদোর প্রাণঘাতী ক্র্যাকডাউনের কারণে কারখানাগুলোও বন্ধ হয়ে পড়েছে। প্রচুর শ্রমিক তাদের নিজ নিজ এলাকায় ফিরে গিয়েছেন। গত বছরও এ খাত থেকে মিয়ানমারের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হয়েছিল ৪০০ থেকে ৬০০ কোটি ডলারের মধ্যে। অভ্যুত্থানের আগে দেশটির গার্মেন্ট শিল্পে কর্মরত ছিল প্রায় ৫ লাখ শ্রমিক। এ খাতের ৮০ শতাংশ কারখানাই ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে কার্যক্রম বন্ধ করে নিতে বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে স্থানীয় শ্রমিক সংগঠনগুলো জানাচ্ছে, জান্তা সরকারের দমন-পীড়ন ও শিল্প এলাকায় সান্ধ্য আইনের কারণে দেশটির পোশাক শিল্পের এক-তৃতীয়াংশ শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
অন্যদিকে মিয়ানমারের নির্মাণ খাতের শ্রমিক সংগঠনগুলো জানাচ্ছে, অভ্যুত্থানের পর থেকে এ খাতের তিন-চার লাখ শ্রমিক বেকার জীবনযাপন করছেন। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে মিয়ানমারের বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াঙ্গুনের বড় অবকাঠামো প্রকল্পগুলো বন্ধ হয়ে পড়েছে। এসব প্রকল্পে বিনিয়োগ স্থগিত করে রেখেছে বিদেশী ও আন্তর্জাতিক অর্থায়নকারীরা। অর্থনৈতিক জোনগুলোরও একই দশা। এ অবস্থায় দেশটির নির্মাণ খাতও এখন পুরোপুরি স্থবির হয়ে পড়েছে।
মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত দশায় দেশটির পুঁজিবাজারও। তাতমাদো ক্ষমতা দখলের পর মার্চে দেশটির পুঁজিবাজার সূচক নেমে আসে ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে। চলতি বছরের মার্চে মিয়ানমারের শেয়ারবাজারে লেনদেনের পরিমাণ নেমে আসে মাত্র ১১ কোটি কিয়াতে (গতকালের বিনিময় হার অনুযায়ী ১ কিয়াত = বাংলাদেশী ৫ পয়সার সামান্য বেশি)। অথচ গত বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ১৪২ কোটি ৫০ লাখ কিয়াত।
এছাড়া ঝাঁকে ঝাঁকে বিদেশী বিনিয়োগকারী এখন মিয়ানমার ত্যাগ করছেন। বিদ্যুৎ খাতের ফরাসি জায়ান্ট ইলেকট্রিসাইট দে ফ্রান্স (ইডিএফ) এরই মধ্যে মিয়ানমারের শান প্রদেশের একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ৬৭১ মেগাওয়াটের ওই প্রকল্পে সংস্থাটির বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৫০ কোটি ডলারেরও বেশি। বিক্ষোভকারীদের ওপর দমন-পীড়ন চালাতে গিয়ে তাতমাদো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে, এমন অভিযোগে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছে ইডিএফ।
তাতমাদো মালিকানাধীন কনগ্লোমারেট এমইএইচএলের সঙ্গে গড়ে তোলা এক জয়েন্ট ভেঞ্চার থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন সিঙ্গাপুরের ধনকুবের লিম কালিং। অভ্যুত্থানের এক সপ্তাহের মাথায়ই বিষয়টি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে দেশটি থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেন তিনি। একইভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে তাতমাদোর মালিকানাধীন কনগ্লোমারেটের সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চার থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছে জাপানি বেভারেজ জায়ান্ট কিরিনও।
ইয়াঙ্গুনের হ্লেউ শহরে একটি শিল্প পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে সিঙ্গাপুরি কনগ্লোমারেট সেম্বকর্প। এ বিষয়ে দেশটিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রায় ২৩ কোটি ডলার ব্যয়ে ৪৩৬ একর জমির ওপর শিল্প পার্কটি গড়ে তোলা হচ্ছিল।
বিশ্বের বৃহত্তম গাড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান টয়োটার একটি গাড়ি উৎপাদনকারী প্লান্ট উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল ইয়াঙ্গুনে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটিও কারখানাটির উদ্বোধন স্থগিত করে দিয়েছে। চলতি বছর উদ্বোধনের পর কারখানাটিতে বার্ষিক আড়াই হাজার হিলাক্স ট্রাক উৎপাদনের পরিকল্পনা ছিল টয়োটার। এছাড়া ইয়াঙ্গুনেই মার্কিন ও থাই বিনিয়োগে একটি শিল্প কমপ্লেক্স গড়ে ওঠার কথা ছিল। ১০০ কোটি ডলারের এ প্রকল্পও বর্তমানে স্থগিত করে দিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
কোন মন্তব্য নেই