ফকির লালন শাহ: মানবতার সাধক, দর্শনের আলো আজও প্রাসঙ্গিক - TIMES EXPRESS | টাইমস এক্সপ্রেস is an interactive news portal

নিউজ ফাস্ট

ফকির লালন শাহ: মানবতার সাধক, দর্শনের আলো আজও প্রাসঙ্গিক

 

ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

ফকির লালন শাহ: মানবতার সাধক, দর্শনের আলো আজও প্রাসঙ্গিক


টাইমস এক্সপ্রেস ২৪ | শাহেরীন আরাফাত

বাংলার ভাবধারার অমর সাধক ফকির লালন শাহ পহেলা কার্তিক, বাংলা ১২৯৭ সালে (১৭ অক্টোবর ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ) তিরোধান করেন। মানবধর্ম, সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধিতা ও চিন্তার স্বাধীনতার প্রতীক এই মহাসাধককে তাঁর অনুসারীরা আজও শ্রদ্ধা ও ভাবগভীরতায় স্মরণ করেন।

লালন ছিলেন এমন এক দার্শনিক, যিনি মানুষকে জাত, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ—সব ভেদাভেদ থেকে মুক্ত হয়ে এক মানবিক সমাজের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তাঁর বিখ্যাত উক্তি—

“সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে,
লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে।”


অজ্ঞাত জন্ম, সীমাহীন প্রভাব

ফকির লালন শাহের জন্মস্থান ও জাতিগত পরিচয় আজও রহস্যময়। তিনি কখনোই নিজের পরিচয় প্রকাশ করেননি, কারণ তাঁর দর্শনের মূলেই ছিল পরিচয়বাদের বিরোধিতা। তিনি নিজেকে কেবল “ফকির” বা “মানুষ” হিসেবে চিনতেন।

জনশ্রুতি আছে, লালন তরুণ বয়সে অসুস্থ অবস্থায় কালীগঙ্গা নদীতে ভেসে আসেন। তাঁকে উদ্ধার করেন মলম শাহ ও তাঁর স্ত্রী মতিজান, যাঁদের সেবা-শুশ্রূষায় তিনি নতুন জীবন পান এবং পরবর্তীতে সেখানেই থেকে সাধনা শুরু করেন।


বাউল নন, ছিলেন ‘ফকির’

অনেকে ভুল করে লালনকে ‘বাউল’ বা ‘বাউল সম্রাট’ বলেন। কিন্তু লালন নিজে কখনো এই পরিচয় গ্রহণ করেননি। লালনপন্থীরা নিজেদের ‘ফকির’ বলেন এবং তাঁরা গুরুপরম্পরার ভাবচর্চার একটি নির্দিষ্ট ধারা অনুসরণ করেন। লালনের সাধনা ছিল সমাজ, প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্কের এক গভীর দার্শনিক উপলব্ধি।


লালনের দর্শন: মানুষ ভজনা ও সাম্যের আহ্বান

লালনের দর্শনে কেন্দ্রীয় স্থান দখল করেছে ‘মানুষ ভজনা’। তাঁর মতে, মানুষই পরমের প্রতিচ্ছবি—

“ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার,
সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার।”

জাতপাত, নারী-পুরুষ ভেদাভেদ ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন কঠোর। তাঁর গানে যেমন মানবতার বার্তা উঠে এসেছে, তেমনি সমাজের শ্রেণী ও বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও রয়েছে।

“যদি ছুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নারীর তবে কী হয় বিধান?
বামন চিনি পৈতা প্রমাণ, বামনী চিনি কিসে রে?”


দেহ, ভাব ও পরমের ঐক্য

লালনের দর্শনে ‘দেহ’ কেবল শারীরিক অবয়ব নয়, বরং জীব ও পরমের মিলনভূমি। তিনি মনে করতেন—মানুষের মধ্যেই পরমের প্রকাশ ঘটে, তাই জীবনের সাধনাই পরমপ্রাপ্তির একমাত্র পথ।

এই দর্শনের ভিত্তিতে লালন মানুষকে প্রকৃতির অংশ হিসেবে দেখেছেন, প্রকৃতির মালিক নয়। তাই তাঁর ভাবচর্চা আজকের পরিবেশ আন্দোলন ও মানবিক সহাবস্থানের দর্শনের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।


জ্যান্তেমরা ও আত্মচেতনার সাধনা

লালনের ‘জ্যান্তেমরা’ ধারণা মানুষকে শেখায়—ভোগ নয়, ত্যাগের মধ্য দিয়েই সত্যের উপলব্ধি সম্ভব। এই ত্যাগ মানে জীবনের অস্বীকার নয়, বরং ভোগবিলাসের ঊর্ধ্বে আত্মচেতনার সাধনা।


বর্তমানে লালনের প্রাসঙ্গিকতা

বর্তমান সময়ে যখন সমাজ ধর্ম, রাজনীতি ও পরিচয়ের বিভাজনে বিপর্যস্ত, তখন ফকির লালন শাহের ভাবচর্চা নতুনভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
তিনি দেখিয়েছেন—মানুষই সকল ধর্মের কেন্দ্র, আর মানবিকতার বাইরে কোনো মুক্তি নেই।

“মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি,
মানুষ ছাড়া ভজনা নাই।”


উপসংহার

ফকির লালন শাহ কেবল এক যুগের সাধক নন, তিনি চিরকালীন মানবতার বার্তাবাহক। তাঁর দর্শন আজও আমাদের শেখায়—মানুষের ভেতরের মানুষকে চেনাই সত্য সাধনা, আর বিভাজনহীন মানবসমাজই তাঁর স্বপ্নের বাস্তব রূপ।

কোন মন্তব্য নেই