অস্বাভাবিক ভিন্নতার এক বাজেট অধিবেশন
মহামারী করোনার প্রভাবে এবার সংসদের বাজেট অধিবেশন, বাজেট পেশ সবই অস্বাভাবিক ভিন্নতায় ভরা। যেখানে তিন-চার ঘণ্টায় অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা শেষ হতো না সেখানে এবার তাতে মাত্র পৌনে এক ঘণ্টা সময় নেয়া হয়। যেখানে বাজেট পেশের দিন সাড়ে তিন শ’ সদস্যের প্রায় সবার উপস্থিতির পাশাপাশি কানায় কানায় ভরা ভিআইপি, দর্শক ও সাংবাদিক গ্যালারির মুখরতায় সংসদে উৎসবের আমেজ বিরাজ করত সেখানে বৃহস্পতিবার ছিল কেবলই শূন্যতা। হাউজের তিন-চতুর্থাংশ আসনই শুধু ফাঁকা থাকেনি, সব ক’টি গ্যালারি ছিল শূন্য। সাংবাদিক ও দর্শনার্থী গ্যালারির পাস ইস্যু করা হয়নি, আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বিদেশী কূটনৈতিকসহ কোনো ভিআইপিকে। মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস আবার কারো মাথায় ভাইরাস প্রতিরোধক আবরণ। ভেতরে-বাইরে কোথাও মন্ত্রী-এমপিদের লোকজনের উপচে পড়া ভিড় ছিল না। চিরাচরিত কুশলবিনিময়ের পরিবর্তে একে অপর থেকে দূরত্ব বজায় রাখার বাধ্যবাধকতা যেন সবাইকে তাড়া করছিল। সবার চোখে মুখেই যেন আতঙ্কের ছাপ। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বৃহস্পতিবার বেলা সোয়া ৩টার দিকে সংসদে আগামী ২০২০-২০২১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট প্রস্তাব পেশ করেন। বৈঠক শুরুর আগে দুপুর ১২টায় সংসদ ভবনের মন্ত্রিসভা কক্ষে মাত্র ১১ জন মন্ত্রীর উপস্থিতিতে বিশেষ মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন হয়। পৌনে এক ঘণ্টায় বাজেট পেশ : স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বৈঠক শুরুর পর মাত্র পৌনে এক ঘণ্টায় শেষ হয় এবারের উপস্থাপন। অতীতে তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টার মতো বাজেট বক্তৃতা দেয়ার রেকর্ড থাকলেও করোনাভাইরাসের কারণে নজিরবিহীন সংক্ষিপ্ততায় বাজেট পেশ করা হয়। গতকালের বৈঠক সব মিলিয়ে ৫০ মিনিট চলে। বাজেট পেশ শেষে অর্থমন্ত্রী অর্থবিল-২০২০ উত্থাপন করেন। বাজেট বক্তব্য সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপন করা হলেও বাজেট বক্তব্য যথারীতি দীর্ঘ ছিল। ছাপার অক্ষরে তা ছিল ১৩০ পৃষ্ঠার। আরেক বড় ধরনের ভিন্নতা ছিল অর্থমন্ত্রী বাজেট উপস্থাপনে নিজে মাত্র ১০ মিনিট কথা বলেন। বাকি সময় উপস্থাপনা চলে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। শুরুতেই স্পিকার অর্থমন্ত্রীকে চাইলেই বসে বাজেট পেশ করতে পারবেন বলে অনুমতি দেন। কিছু অংশ পঠিত বলে গণ্য করা এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে উপস্থাপনের অনুমতি নিয়ে নেন অর্থমন্ত্রী। বাজেট পেশের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী সংসদ কক্ষে উপস্থিত ছিলেন। বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ অধিবেশনে যোগ দেননি। অধিবেশনে উপস্থিতির জন্য চিফ হুইপ কর্তৃক তৈরি শিডিউল অনুযায়ী ৮০-৯০ জনের মতো সংসদ সদস্য যোগ দেন। পরিস্থিতির শিকার অর্থমন্ত্রী : অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের এটি ছিল দ্বিতীয় বাজেট পেশ। কিন্তু তার দু’টি বাজেট পেশের পরিবেশই স্বাভাবিক-স্বাচ্ছন্দ্যময় ছিল না তার জন্য। গত বছর সংসদের বাজেট পেশের আগে পরে ডেঙ্গজ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। বাজেট পেশের দিন অসুস্থতা নিয়ে সংসদে গেলেও বাজেট পেশের একপর্যায়ে থেমে যান তিনি। তার পক্ষে বাকি বাজেট বক্তব্য পেশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বছর অর্থমন্ত্রী শারীরিকভাবে সুস্থ থাকলেও করোনা মহামারীর কারণে তাকে একেবারেই সংক্ষিপ্তভাবে ভিন্ন আঙ্গিকে বাজেট পেশ করতে হয়েছে। তবে তার পেশ করা দেশের ৪৯তম বাজেটটি দেশের সবচেয়ে বড় বাজেট, যার আকার পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার। দেশের প্রথম বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা, যেটি ১৯৭২ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ পেশ করেন। করোনা প্রসঙ্গ ও কুরআনের উদ্ধৃতি : করোনা প্রসঙ্গ স্থান পায় অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতায়। করোনাভাইরাসজনিত মহামারীর অমানিশার অন্ধকার একদিন কেটে যাবে বলে দৃঢ় আশা প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী। বাজেট বক্তব্যের শেষে অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সৃষ্ট দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার মানুষকে এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা। পাশাপাশি দেশের মানুষের অন্ন-বস্ত্র জোগানের জন্য দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখা। তিনি পবিত্র কুরআনের সূরা আল বাকারাহ’র ১৫৫ নম্বর আয়াত উল্লেখ করে বলেন, সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন-‘তিনি তার সৃষ্টির অকল্যাণে কিছুই করেন না, যা করেন কল্যাণের জন্যই করেন’। তাই অবশ্যই অচিরে তিনি তার কল্যাণের সুশীতল ছায়াতলে আমদেরকে আশ্রয় দিয়ে এই মহামারী ভাইরাস থেকে সবাইকে পরিত্রাণ দান করবেন এবং আমরা ফিরে যাবো আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়, উন্মোচিত হবে এক আলোকিত ভোরের। করোনা স্বাস্থ্যবিধির কড়াকড়ি : করোনার সংক্রমণ এড়াতে বিশেষ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে এবারে বাজেট অধিবেশন চলছে। সংসদ সদস্যরা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে মাস্ক ও গ্লাভস পরে অধিবেশনে অংশ নিচ্ছেন। ভেতরে আসন বিন্যাসে পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর আশপাশের বেশ কয়েকটি আসন ফাঁকা রাখা হয়েছে। অন্যদের আসনও দূরত্ব বজায় রেখে নির্ধারণ করা হয়েছে। অধিবেশনের জন্য সংসদ সচিবালয় ক্যালেন্ডার তৈরি করেছে। তাতে ১২ কার্যদিবস অধিবেশনের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে। আগামী ৩০ জুন বাজেট পাস হবে। তারপর আগামী ৯ জুলাই অধিবেশন শেষ হবে। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত চলবে অধিবেশন। বাজেটের ওপর এবারই সবচেয়ে কম সময় - ২০ থেকে ২২ ঘণ্টা আলোচনা হতে পারে। অধিবেশনের সাথে সংশ্লিষ্ট অত্যাবশ্যকীয় সংসদ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া অন্যদের উপস্থিত না হতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যারা অংশ নিচ্ছেন তাদের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রয়েছে কি না তা পরীক্ষা করা হয়েছে। গত সোমবার পর্যন্ত যাদের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে তাদের ৪৩ জনের শরীরে করোনার উপস্থিতি পাওয়া যায়। এতে সংসদসংশ্লিষ্টদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। সংসদের মূল ভবনে ঢোকার আগে ‘জীবাণুমুক্তকরণ চেম্বারের’ ভেতর দিয়ে সব সংসদ সদস্য ও সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রবেশের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। শরীরের তাপমাত্রা মাপাসহ জীবাণুনাশকের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। দর্শকশূন্য গ্যালারি : অন্যান্য বছর বাজেট পেশের দিন সংসদ সদস্যের বাইরেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে সংসদ ভবন সরব থাকলেও এবার তা লক্ষ করা যায়নি। অন্য বছরগুলোতে সরাসরি বাজেট অধিবেশন প্রত্যক্ষের জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, ঢাকায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, আন্তর্জাতিক মিশনগুলোর প্রতিনিধি, দেশের অর্থনীতিবিদ, প্রধান বিচারপতিসহ বিচারপতি, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার প্রধান, বিভিন্ন পেশাজীবী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি, সম্পাদকসহ সিনিয়র সাংবাদিক ও বিশিষ্টজনদের আমন্ত্রণ জানানো হলেও এবার কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। সংবাদ সংগ্রহে সাংবাদিকদের সংসদে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়নি। সংসদ টেলিভিশন দেখে সংবাদ সংগ্রহের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সংসদের বাজেট ডকুমেন্টসও এবার দেয়া হয় বাইরে মিডিয়া সেন্টারে। বাজেট ডকুমেন্টসও এবার সংক্ষিপ্ত করা হয়।
কোন মন্তব্য নেই