‘ফ্লাইট এক্সপার্ট’ ফাঁস করল ওটিএ খাতের লোভনীয় ফাঁদ, সামনে আরও বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা - TIMES EXPRESS | টাইমস এক্সপ্রেস is an interactive news portal

নিউজ ফাস্ট

‘ফ্লাইট এক্সপার্ট’ ফাঁস করল ওটিএ খাতের লোভনীয় ফাঁদ, সামনে আরও বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা

 

টাইমস এক্সপ্রেস ডেস্ক: দেশের অনলাইন ট্রাভেল এজেন্ট (ওটিএ) খাত যেন একের পর এক ‘উড়ছে’ আর ফাঁকা মাঠে রেখে যাচ্ছে হাজারো গ্রাহক আর ছোট ট্রাভেল এজেন্সিকে। সর্বশেষ আলোচিত অনলাইন প্লাটফর্ম ‘ফ্লাইট এক্সপার্ট’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনায় নতুন করে সামনে এসেছে ওটিএ ব্যবসার দুর্নীতি আর অনিয়মের ভয়াবহ চিত্র।

বড় অঙ্কের জামানত আর অগ্রিম টাকা জমা নিয়ে হঠাৎই উধাও হয়ে যাওয়া ওটিএগুলোর তালিকায় পঞ্চম নাম হিসেবে যুক্ত হলো ‘ফ্লাইট এক্সপার্ট’। আগে যারা ভেগেছে তাদের মতোই— এবারও হাজারো গ্রাহক আর ছোট ট্রাভেল এজেন্সি পড়ে গেছে অনিশ্চয়তার মুখে।

লভ্যাংশের লোভে কোটি কোটি টাকার ফাঁদে আটকে এজেন্সিগুলো

ওটিএগুলোর প্রলোভন পুরনো হলেও পদ্ধতিটা একটু অন্যরকম। সরাসরি এয়ারলাইন্সের চেয়েও কম দামে টিকিট, ডিপোজিটের বিপরীতে ৫-৭% লভ্যাংশ আর ‘বিশ্বাসের আশ্বাস’— এসব দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে। যখন এক পর্যায়ে বড় অঙ্কের টাকা জমা হয়ে যায়, তখনই শুরু হয় উধাও হওয়ার খেলা।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস (আটাব) বহুবার নীতিমালা করার দাবি জানালেও সরকারের নীরবতা এবং নজরদারির অভাবেই একের পর এক এমন ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ সংগঠনের নেতাদের। আটাবের সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম আরেফ সরাসরি বলেন, “ওটিএগুলোর ব্যবসার মডেলটাই এখন হয়েছে ‘কালেক্ট মানি অ্যান্ড রান’। যতক্ষণ না পর্যন্ত সরকার কঠোর নীতিমালা দিচ্ছে, ততদিন এই প্রতারণা চলতেই থাকবে।”

এয়ারলাইন্স-ওটিএ-এজেন্সি ত্রিভুজের ছলচাতুরি

ডলার সংকট শুরু হওয়ার পর থেকেই বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো স্থানীয় ট্রাভেল এজেন্সির বদলে ওটিএগুলোর মাধ্যমে টিকেট বিক্রি শুরু করে। কারণ, ওটিএগুলো বড় অঙ্কের অগ্রিম অর্থ প্রদান করে, যা ট্রাডিশনাল এজেন্সিগুলোর পক্ষে সম্ভব ছিল না। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ওটিএগুলো ঢুকে পড়ে এক নতুন ধরনের মানি ম্যানেজমেন্টের ফাঁদে।

‘ফ্লাইট এক্সপার্ট’ এ খাতের পুরনো ব্যবসায়ী এম এ রশিদের ছেলে সালমানের নেতৃত্বে ২০১৭ সালে যাত্রা শুরু করে। দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্সের টিকেট, হোটেল বুকিং, ট্যুর প্যাকেজ—সবই ছিল তাদের সেবার আওতায়।

কিন্তু, আড়ালে তারা ছোট ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে বড় অঙ্কের ডিপোজিট নিয়ে, সেই অর্থ দিয়ে কমদামে টিকিট দিয়ে আরও এজেন্সিকে ফাঁদে ফেলত। এমনকি নিজের আয়াটা (IATA) অ্যাকাউন্ট ব্যবহার ছাড়াও, অন্য এজেন্সির আইডি শেয়ার করে টিকেট বিক্রি করতো তারা। যার ফলে আজ গ্রাহকরা শুধু টিকিট হারাচ্ছেন না, সেই সঙ্গে হারাচ্ছেন লাখ লাখ টাকার বিনিয়োগও।

৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা প্রতারণার অভিযোগ

সরকার ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের মালিক বিপুল সরকার মতিঝিল থানায় দায়ের করা মামলায় অভিযোগ করেছেন, ‘ফ্লাইট এক্সপার্ট’ ১৭টি এজেন্সির প্রায় চার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। তবে তিনি আশঙ্কা করছেন, প্রকৃত অর্থে এ ক্ষতির পরিমাণ ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। ইতোমধ্যেই কোম্পানিটির তিন কর্মী গ্রেপ্তার হলেও মালিক সালমান বিন রশিদ এবং তার বাবা এম এ রশিদের কোনো সন্ধান নেই।

বিপুল সরকার বলেন, “টিকিটগুলো ক্যান্সেল হতে শুরু করেছে। ইউরোপ, আমেরিকার বড় বড় রুটের টিকেট বাতিল হয়ে যাচ্ছে। ক্ষতির পরিমাণ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটার হিসাব আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারছি না।”

‘কালেক্ট মানি অ্যান্ড রান’— এটিই এখনকার ওটিএ মডেল

আটাব বলছে, ওটিএ খাতে নিয়ন্ত্রণহীনতা ও নজরদারির অভাবে বারবার প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে বিটুবি (ব্যবসা থেকে ব্যবসায়) মডেলে এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে ডিপোজিট নেয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বিপজ্জনক। তারা টিকিটে ছাড় দেয়ার পাশাপাশি ব্যাংকের মতো সুদও দিয়ে থাকে। কিছুদিন পরেই সেই ফাঁদে আটকে যায় অসংখ্য এজেন্সি।

এ পর্যন্ত ‘টোয়েন্টিফোর টিকেট ডটকম’, ‘হালট্রিপ’, ‘লেটস ফ্লাই’ ও ‘ফ্লাই হাব’ উধাও হয়ে গেছে এভাবেই। সবশেষে ‘ফ্লাইট এক্সপার্ট’ও একই কায়দায় পালাল।

‘নতুন নীতিমালা ছাড়া বিপর্যয় থামানো যাবে না’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওটিএ বিষয়ক নির্ভরযোগ্য ও সময়োপযোগী নীতিমালা না হলে ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার ঘটনা ঘটতে বাধ্য। প্রয়োজন বিটুবি ব্যবসায় নিরুৎসাহিত করা, কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন বাড়ানো এবং আইডি শেয়ারিং বন্ধ করা।

আটাবের সাবেক সভাপতি আরেফ বলেন, “এখন যারা লিডিং ওটিএ, তাদের বেশিরভাগেরই মালিকানা রয়েছে আমেরিকা, কানাডা বা সিঙ্গাপুরের পাসপোর্টধারীদের হাতে। তারা একদিনে টাকা তুলবে, পরদিনই উধাও হয়ে যাবে। সময় থাকতে থাকতেই ব্যবস্থা নিতে হবে।”

এদিকে, পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

শেষ কথা: ওটিএ খাতের দায় কার?

বারবার এমন ঘটনা ঘটলেও, প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিরবতা এই খাতের প্রতি অব্যবস্থাপনার চিত্রই ফুটিয়ে তুলছে। বড় বড় ওটিএর মালিকরা যখন দেশ ছাড়ছে, তখন ছোট এজেন্সিগুলোর স্বপ্নও ডুবছে।

এখন প্রশ্ন হলো— সরকারের টনক কখন নড়বে?


✍️ টাইমস এক্সপ্রেস ২৪ | রোকন 

কোন মন্তব্য নেই