বাড়ছে কনটেইনার জট সমন্বয়হীনতা চরমে
চট্টগ্রাম বন্দরসহ আইসিডিগুলোতে কনটেইনার জট বেড়েই চলেছে। আশ্বাসের ফাঁদে সবকিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। অচল কমলাপুর আইসিডি, কাজ হচ্ছে না পানগাঁও বন্দরেও। চলছে একে অপরকে দোষারোপের প্রতিযোগিতা। দায়িত্বে অবহেলা ও সমন্বয়হীনতা চরমে। এই আপৎকালীন সময়ে সীমিত পরিসরে কাস্টমস খোলা থাকলেও সেখানে অনেকে অনুপস্থিত।
এছাড়া পণ্য খালাসের সঙ্গে জড়িত অন্য সংস্থার মধ্যে বিএসটিআই, উদ্ভিদ সংঘনিরোধ কেন্দ্র, রেডিয়েশন দফতরের সনদপ্রাপ্তির জটিলতায় শিল্প মালিকরা কনটেইনার খালাস নিতে পারছেন না। ব্যাংকও খোলা থাকছে সীমিত সময়ের জন্য। রোস্টার অনুযায়ী কাস্টমস কর্মকর্তাদের অফিস করার কথা থাকলেও অনেকে করোনার অজুহাতে অফিসে হাজিরা দিয়েই চলে যাচ্ছেন।
এ কারণে একদিকে বন্দরে কনটেইনার জট যেমন বাড়ছে, তেমনি শিল্প মালিকদের বন্দর ও শিপিং লাইনের ডেমারেজ গুনতে হচ্ছে। এ বিষয়ে ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে আবেদন-নিবেদন জানানো হলেও সমাধান মিলছে না।
এদিকে সংকট নিরসনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে শনিবার দুটি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে উল্টো আমদানিকারকদের ওপর খরচের বোঝা বাড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে সব দিক থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত। এ অবস্থায় যেখানে সরকারি সংস্থাগুলো দ্রুততার সঙ্গে সেবা দিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখবে, সেখানে দায়িত্বে অবহেলা ও সমন্বয়হীনতার কারণে শিল্প মালিকদের অবস্থা আরও বেগতিক হচ্ছে। বন্দরে আনা পণ্যও খালাস করা যাচ্ছে না। এনবিআর সীমিত আকারে কাস্টমস খোলা রাখতে বললেও কাস্টমস হাউসগুলোতে তা শুধু খাতা-কলমে বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
কর্মকর্তারা রোস্টার অনুযায়ী অফিসে আসছেন শুধু হাজিরা খাতায় স্বাক্ষরের জন্য। পণ্যের অ্যাসেসমেন্টের পরিবর্তে ব্যক্তিগত সুরক্ষার কথা ভেবে প্রকারান্তরে কাজই বন্ধ রাখছেন। অন্যদিকে পণ্য চালান খালাসে যদি বিএসটিআই, উদ্ভিদ সংঘনিরোধ কেন্দ্র, এটমিক এনার্জি কমিশনের সনদের প্রয়োজন পড়ে তাহলে তো ভোগান্তির শেষ নেই। ওইসব সংস্থার সনদের পেতে আরও গলদঘর্ম পোহাতে হয়। সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা নিজ দফতরে অফিসও করছেন না। ফলে সনদ মিলছে না। এতে করে অতিরিক্ত মাশুল গুনতে হচ্ছে শিল্প মালিকদের।
দেশের শীর্ষস্থানীয় এক ব্যবসায়ী বলেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ‘?একজনের অবহেলার মাশুল আরেকজন দিচ্ছে। তা না হলে যেসব সংস্থার অবহেলার কারণে এই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কেন নেয়া হচ্ছে না?’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার ফখরুল আলম যুগান্তরকে বলেন, ‘এনবিআরের নির্দেশনা মোতাবেক কাস্টমস সীমিত আকারে খোলা রয়েছে। তবে সাধারণ ছুটির প্রথমদিকে অন্য সংস্থাগুলো নির্দেশনার অভাবে অফিস খোলা রাখা, না রাখার বিষয়ে দ্বিধান্বিত ছিল। ১৪ এপ্রিল সার্কিট হাউসে মিটিংয়ের পর এখন সব সংস্থাই সেবা দিচ্ছে।’ তিনি দাবি করেন, বর্তমানে সব সংস্থাই সেবা দিচ্ছে। তবে অনেক সময় আমদানিকারকরাই কনটেইনার নিতে আসছেন না।’
কমলাপুর আইসিডির কমিশনার মোবারা খানমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা দাবি করেন, ‘কমিশনারের রোস্টার অনুযায়ী কর্মকর্তারা নিয়মিত অফিস করছেন। কিন্তু কনটেইনার খালাসের ক্ষেত্রে পণ্যভেদে কিছু সনদ লাগে। সেগুলো না পাওয়া পর্যন্ত কাস্টমস চাইলেও মাল খালাস করতে পারে না। আমদানিকারক ওইসব সংস্থার সনদ না আনা পর্যন্ত কামস্টমের করার কিছুই নেই।’
এদিকে কনটেইনার জট কমাতে এনবিআর থেকে শনিবার দুটি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একটি নির্দেশনায় চট্টগ্রামের আশপাশে অবস্থিত প্রাইভেট আইসিডিতে ৩৮টির পাশাপাশি নতুন আরও ৬ আইটেমের পণ্য শুল্কায়নের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- সব ধরনের বীজ; সব ধরনের ফাইবার; ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের আমদানিকৃত ওষুধ প্রশাসন অনুমোদিত ব্লক লিস্টের পণ্য, সুতা, কীটনাশক, উদ্ভিদনাশক, ছত্রাকনাশক এবং টায়ার কর্ড। এসব পণ্য ৩০ জুন পর্যন্ত আইসিডিতে খালাস করা যাবে।
অপর নির্দেশনায় কমলাপুর আইসিডিতে শুল্কায়নের উদ্দেশ্যে আনা কনটেইনার মুন্সীগঞ্জের সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেডে খালাস করা যাবে। এক্ষেত্রে ৬টি শর্ত মানতে হবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- কনটেইনার শুধু নদীপথে রিভার টার্মিনালে আনতে হবে। ইমপোর্ট মেনিফেস্টো সংশোধন বা স্ট্যাটাস পরিবর্তন করা যাবে না। আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত এ সুবিধা বহাল থাকবে।
তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়হীনতার কারণে বন্দরে কনটেইনার জট দেখা দিয়েছে। কিন্তু এর মাশুল গুনতে হবে শিল্প উদ্যোক্তাদের। সরকারের সব দফতরের কর্মকর্তারা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে রোস্টার অনুযায়ী অফিস করলে এবং জরুরি ট্রাক-লরি চলাচলে শিথিলতা দিলে বন্দরে জট লাগত না। এখন কমলাপুর আইসিডির কনটেইনার খালাসে এনবিআর থেকে যেই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সে অনুযায়ী মুন্সীগঞ্জে আনতে জাহাজ ভাড়া কে দেবে? তাছাড়া চট্টগ্রামে পণ্য খালাস করতে পারলে কমলাপুর আইসিডিতে আনতে যাবে কেন। মূলত দরকার, দ্রুত কনটেইনার ছাড় করতে সব ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পরিহার করা।
এ বিষয়ে বিকেএমইএ’র জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম যুগান্তরকে বলেন, ‘জট কমাতে আমরা সদস্যদের কনটেইনার খালাস নিতে বলেছি। কিন্তু ট্রাক-লরি চলাচল সীমিত থাকায় চাইলেও পণ্য খালাস নেয়া যাচ্ছে না। অপরদিকে কিছু আইটেম খালাসে বিএসটিআই, উদ্ভিদ সংঘনিরোধ কেন্দ্র, রেডিয়েশন সনদ লাগে। ওইসব সংস্থার সনদ না পাওয়ার কারণেও পণ্য খালাস নেয়া যাচ্ছে না। দেখা গেছে, ব্যবসায়ীর কোনো দোষ নেই। কিন্তু তারপরও অন্যের গাফিলতির কারণে বন্দর ও শিপিং লাইনের ডেমারেজ গুনতে হবে। এই সময়ে যা ব্যবসায়ীদের জন্য পাহাড়সম বোঝা।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই আপৎকালীন সময়ে অন্য সংস্থার সনদ যাতে অনলাইনে পাওয়া যায়, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হলে খুব দ্রুতই কনটেইনার জট হ্রাস পাবে বলে মনে করি।’
চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার জট : কনটেইনার রাখার আর জায়গা নেই। বিভিন্ন ইয়ার্ডে ৪৯ হাজার ১৮ টিইইউএস (২০ ফুট সমমানের) কনটেইনার রাখার যেখানে ধারণ ক্ষমতা সেখানে এর বিপরীতে শনিবার কনটেইনার ছিল ৪৮ হাজার ৪৬৮ টিইইউএস। শুক্রবার ছিল আরও বেশি- ৪৮ হাজার ৮৪৯ টিইইউএস। স্বাভাবিক সময়ে ইয়ার্ডে কনটেইনার থাকে ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টিইইউএস। ইয়ার্ডে জায়গা না থাকায় বন্দরের অভ্যন্তরে পণ্য হ্যান্ডলিংও কমে গেছে।
এ কারণে বন্দর জেটি ও বহির্নোঙরে অপেক্ষমাণ রয়েছে ১১৯টি জাহাজ। এর মধ্যে কনটেইনারবাহী জাহাজই রয়েছে ৪৪টি। অপরদিকে কমলাপুর আইসিডিতে কনটেইনার রাখার কোনো জায়গা নেই। জায়গার অভাবে বহু কনটেইনার পানগাঁও আইসিডিতে পাঠানো হয়েছে। সেখানেও একই অবস্থা বিরাজ করছে।
কোন মন্তব্য নেই